লেখক পরিচয় ‘বেশি পছন্দ’ অস্কারজয়ী টিল্ডা সুইনটনের

মঞ্চনাটক থেকে উঠে এসে রূপালি পর্দায় অভিনয়ে অস্কার জয় করলেও স্কটিশ অভিনেত্রী টিল্ডা সুইনটন নিজেকে লেখক হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Nov 2017, 04:27 PM
Updated : 17 Nov 2017, 04:48 PM

ঢাকার বাংলা একাডেমিতে ঢাকা লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিনের আয়োজনে অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন এই লেখক-অভিনেত্রী। শুক্রবার দুপুরে সাহিত্য উৎসবে ‘পারফরম্যান্স অ্যাজ অথরশিপ’ শিরোনামের একটি সেশনে অংশ নেন তিনি।

নিজের পরিচয় পর্বে টিল্ডা বলেন, “মঞ্চ থেকে উঠে এসেছি, সিনেমাতেও অভিনয় করেছি। কিন্তু লেখালেখির ভুবনে আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। আমি নিজেকে লেখক হিসেবে পরিচয় দিতেই বড় ভালোবাসি।”

নিজের লেখা বই ‘মাই ওল্ড ম্যান’ থেকে একটা অংশ পড়ে শোনান তিনি।

তিন দশকের বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্রে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করা টিল্ডা সুইনটন জানান, অভিনয়ের ব্যস্ততার মাঝে লেখালেখি থেকে দূরে সরে গেলেও পরে আবার ফিরে এসেছেন।

তরুণ লেখকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “লেখালেখি বন্ধ করো না, আমি এই লেখালেখির জগতে নিজেকে বারবার খুঁজে পেয়েছি, জীবনের ছন্দ খুঁজে পেয়েছি। মনে হয়, আমার জীবনের লক্ষ্যই ছিল যেন আমি লেখালেখি করব। কোনো কিছুতেই এত আনন্দ পাইনি।”

তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- ইম্পসিবল ওয়্যারড্রোবস, উই কান্ট ডু দিজ অ্যালোন: জেফারসন হ্যাক দ্য সিস্টেম, ডেরেক জার্মান: স্কেচ বুকস, ক্রিসটোফ শেলিনজেনশিফ, বায়োগ্রাফি সিরিজ- ‘অরলান্ডো’, ‘স্যরি টু মেক ইউ থ্রু আপ’, ‘মনো কুটলুর’, ‘উইটজেনস্টেইন’, ‘টিল্ডা সুইটন ইন ফ্যাশন’।

অভিনয় জীবন সম্পর্কে টিল্ডা বলেন, “আমি পারফর্ম করতে ভালোবাসি, আর এটাই আমার অভিনয় জীবনের আসল কথা। মঞ্চে বলুন বা সিনেমাতে, আমি যে কোনো চরিত্রের ভেতরে এতই ডুবে থাকতে ভালোবাসি যে বাস্তব সত্ত্বাই ভুলে বসি। সত্যি বলি, আমি এখন অবধি যেসব সিনেমাতে অভিনয় করেছি, তৃপ্ত হইনি। আমি এখনো মনের মতো চরিত্র খুঁজে ফিরি। চরিত্রের মধ্য দিয়ে আমি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চাই।”

‘মাইকেল ক্লেটন’ চলচ্চিত্রে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের জন্য অস্কার জিতেছেন টিল্ডা সুইনটন।

তার অভিনয়ের শুরু মঞ্চনাটকে। লন্ডনের রয়েল শেকসপিয়ার কোম্পানির সঙ্গে কাজ করেন তিনি। অভিনয়ের পাশাপাশি লেখালেখিটাও চলতে থাকে সমানতালে।

ডেরেক জার্মানের ‘কারাভাগিও’ সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসেন টিল্ডা। ‘দ্য গার্ডেন’, ‘দ্য লাস্ট অফ ইংল্যান্ড’-নামে জার্মান ভাষার দুটি সিনেমাতে অভিনয় করেছেন। পরে ‘অরলান্ডো’, ‘ফিমেইল পারভারশনস’, ‘দ্য ডিপ অ্যান্ড থাম্ব সাকার’র পাশাপাশি ‘দ্য ক্রনিকালস: দ্য লায়ন, দ্য উইচ, দ্য ওয়ারড্রোব’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি।

টিল্ডা মনে করেন, শিশুদের ওপর লেখাপড়ার জন্য চাপ প্রয়োগ একেবারেই উচিত নয়।

তিনি বলেন, “এই পরীক্ষা ব্যাপারটি শিশু মনের উপর চাপ প্রয়োগ করে। আমার মনে  হয়, এই পরীক্ষা ব্যাপারটি একেবারে বাদ দিলেই ভালো হত। পৃথিবীর কোথাও কোনো পরীক্ষা হবে না। ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সটা শিশুরা নিজেকে জানবে, বহির্বিশ্বকে জানবে। নিজের জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নেবে।”

ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় শিশুরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের হারিয়ে ফেলছে মন্তব্য করে এজন্য অভিভাবকদের দায়ী করেন টিল্ডা সুইনটন।

তিনি বলেন, “ষোলো বছর বয়সের আগে শিশুদের হাতে কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসই তুলে দেওয়া উচিত নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এদের কুঁড়ে খাচ্ছে।”

প্রথমবারের মতো ঢাকায় এসে বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ টিল্ডা সুইনটন।

“এখানকার মানুষগুলো খুব উদারমনা।সবাই সবার বন্ধু, এত কাছাকাছি থাকে এরা! আনন্দের উপলক্ষ পেলে এরা একসঙ্গে মেতে উঠে।”

উৎসবের দ্বিতীয় দিনের উল্লেখযোগ্য সেশন

উৎসবের দ্বিতীয় দিনে ৩৮টি অধিবেশনের আলোচনায় সাহিত্যের পাশাপাশি উঠে এসেছে সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ইতিহাসসহ নানা বিষয়াদি। এসবের সঙ্গে ছিল বিশ্ব সাহিত্যের নানা বইয়ের বিকিকিনিও।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ‘ফ্রম জানাদু টু নাইন লাইফস’ শীর্ষক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের লেখক সাজিয়া ওমরের সঞ্চালনায় আলোচনা করেন ব্রিটিশ লেখক উইলিয়াম ডালরিম্পল। কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে ‘অক্ষর ও অঙ্ক’ শীর্ষক অধিবেশনে ভারতীয় সাহিত্যিক গার্গ চট্টোপাধ্যায়ের সঞ্চালনায় অংশ নেন মৌসুমী ব্যানার্জি। ভাস্কর নভেরা প্রদর্শনীলয়ে ‘ক্রিটিকাল মুসলিম: লঞ্চ অব বাংলাদেশ ইস্যু’ শীর্ষক অধিবেশনে পাকিস্তানের আমির হুসাইনের সঞ্চালনায় আলোচনা করেন কবি কায়সার হক, মারিয়া চৌধুরী, রাজিব রহমান ও সর্বরী আহমেদ। কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে ‘এন অ্যান্ড দ্যা বিগ হুম’ শীর্ষক অধিবেশনে সাহাদাত জাহানের সঞ্চালনায় আলোচনা করেন পেঙ্গুইন ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা জেরি পিন্টো। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ‘মাদার অ্যান্ড ডটার’ শীর্ষক অধিবেশনে সারা যাকেরের সঞ্চালনায় আলোচনা করেন ভারতীয় লেখক-অভিনেত্রী নন্দনা সেন।

উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ছিল ‘চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন’ শীর্ষক অধিবেশন; এতে অংশ নেন হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন।

দুপুর ২টায় কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে ‘মেমোরিস অব এ পাবলিশার্স’ শীর্ষক অধিবেশনে ইউপিএলের পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিনের সঞ্চালনায় আলোচনা করেন বিশ্বখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা পেঙ্গুইন র‌্যান্ডম হাউজের সদ্য সাবেক প্রধান জন ম্যাকিনসন।

উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ‘#মিটু’ শীর্ষক অধিবেশনে জ্যোতি মালহোত্রার সঞ্চালনায় আলোচনা করেন সাবিনা ফয়েজ রশিদ, সামিয়া জামান, সোফি ওয়াকার ও বাচি কাকারিয়া।

বিকেল সোয়া ৩টায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ‘দ্য ফেমিসেড রোড’ শীর্ষক অধিবেশনে জেরি পিন্টোর সঞ্চালনায় আলোচনা করেন ম্যানবুকার পুরস্কারজয়ী নাইরেজিয়ান কথাসাহিত্যিক বেন অকরি।

বিকেল সাড়ে ৪টায় ওই মিলনায়তনে ছিল ‘হার স্টোরিজ: হোমগ্রো সুপারগার্লস’ শীর্ষক অধিবেশন, সেতু সবুরের সঞ্চালনায় আলোচনা করেন মাবিয়া আক্তার, মাদিয়া মোরশেদ, নাঈমা হক, এভারেস্টজয়ী প্রথম বাংলাদেশি নারী নিশাত মজুমদার ও তামান্না-ই-লুৎফি। এ সময় ‘হার স্টোরিজ: হোমগ্রো সুপারগার্লস’ শিরোনামে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।

সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় একই মিলনায়তনে ছিল ‘স্যাডো ওয়ার্ল্ড’ প্রামাণ্যচিত্রের দক্ষিণ এশিয়া প্রিমিয়ার। আন্ড্রু ফেইনস্টেনের আলোচিত গ্রন্থ ‘দ্যা স্যাডো ওয়ার্ল্ড: ইনসাইড গ্লোবাল আর্মস ট্রেড’ অবলম্বনে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রটির উপরে শুরুতেই আলোচনা করেন আনাদিল হোসেন।

সাংস্কৃতিক আয়োজন

লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিনে ছিল নানা সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। কসমিক টেন্টে সকালে নাজিয়া জেবিন শিশুদের শোনান ‘তোতন মামার ম্যাজিক খেলা’ গল্পটি। বিকালে একই স্থানে ‘মাম্বি অ্যান্ড নট ইয়েট!’ শীর্ষক অধিবেশনে বাচ্চাদের সঙ্গে আলাপ আর খেলায় মেতে উঠেন ভারতীয় অভিনেত্রী নন্দনা সেন।

সকালে নজরুল মঞ্চে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ লাঠিয়াল দলের অংশগ্রহণে হয় মেয়েদের লাঠি খেলা। নাট্যদল বটতলা পরিবেশন করে সুকুমার রায়ের নাটক। মুস্তফা মনোয়ারের পরিচালনায় পুতুল নাচ এবং অজিত রায় সরকার, নির্মল চন্দ্র রায় সরকার ও দলের কবিগান হয় এখানে।

ৎসবের শেষ দিনের আয়োজন

শনিবার উৎসবের শেষ দিনে ব্রিটিশ সাহিত্য জার্নাল ‘গ্রান্টা’র মোড়ক উন্মোচন হবে এবং দক্ষিণ এশিয়ার সম্মানজনক সাহিত্য পুরস্কার ‘ডিএসসি পুরস্কার’ প্রদান ছাড়াও ৩৭টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।