ক্ষমতাসীনের কথা বলা কবিতা বড় দুর্বল, গুরুত্বহীন: অ্যাডোনিস

ক্ষমতাসীনের স্তুতি বা গুণকীর্তনে মেতে থাকা কবিদের সমালোচনা করলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আরব কবি আলী আহমদ সাঈদ আসবার, যিনি কবি অ্যাডোনিস নামেই সমধিক পরিচিত।

জয়ন্ত সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Nov 2017, 07:09 PM
Updated : 16 Nov 2017, 07:14 PM

ঢাকা লিট ফেস্টের উদ্বোধনী দিনের এক আসরে তিনি বলেন, “যে কবিতা সব সময় ক্ষমতাসীনদের কথা বলে, তাদের স্তব-স্তুতিতে মেতে থাকে, তার কোনো গুরুত্ব নেই আমার কাছে।এসব কবিতার কোনো শক্তি নেই, এগুলো বড় দুর্বল কবিতা। কাব্য সাহিত্যের ধারাতেও এগুলো কখনো যুক্ত হতে পারে না।”

বৃহস্পতিবার সকালে শুরু হওয়া ঢাকা লিট ফেস্টের উদ্বোধন শেষে ‘অ্যাডোনিস’ শিরোনামের এক অধিবেশনে যোগ দিয়ে কবি এসব কথা বলেন।

পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় নিজের জীবনের নানা গল্পের পাশাপাশি আরব সাহিত্য, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করেন কবি।

শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী আলাইও সম্প্রদায়ের আলী আহমদ সাঈদ আসবার ছোটবেলায় ঝুঁকে পড়েন আরবি সাহিত্যে। ধীরে ধীরে তার নিজের মধ্যেই কাব্যপ্রতিভার বিকাশ ঘটতে থাকে। পরে ১৯৪৮ সালে তিনি অ্যাডোনিস নামে সাহিত্যিক মহলে পরিচিত হয়ে উঠেন।

সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের আল কোয়াসবিন লাটাকিয়ায় ১৯৩০ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম অ্যাডোনিসের। দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্র থেকে ডিগ্রি নিয়ে তিনি পরে সিরিয়ার সোশ্যালিস্ট ন্যাশনালিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এই দলে যোগ দেওয়ার অপরাধে তার ছয় মাসের কারাদণ্ড হয়।

জন্মভূমি ছেড়ে প্রথমে লেবানন, পরে সেখানে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তিনি চলে যান প্যারিসে। এখন তিনি সেখানেই থাকেন।

কবি অ্যাডোনিস বলেন, ১৯৫৭ সালে কবিতাবিষয়ক পত্রিকা ‘মাজ্জাল্লাতুশ শের’এ কবিতা ছাপা হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। সে সময় তার কবিতায় আধ্যাত্মিকতার প্রভাব পড়ে। মরমিবাদ তার কবিতা দর্শনের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠে।

কবিতার প্রতি আগ্রহ বোঝাতে অ্যাডোনিস বলেন, “আমার মা দুজন। প্রথমজন আমার জন্মদাত্রী আর দ্বিতীয়টি হল কবিতা। পৃথিবীটা যদি ফুল হয় কবিতা হচ্ছে তার সৌরভ।”

তিনি বলেন, প্রথমে স্বনামে কবিতা লেখা শুরু করেন। সে সময় সাহিত্য সম্পাদকরা তার কবিতা ছাপতে রাজি ছিলেন না। পরে নাম পরিবর্তন করে যখন আরব জীবন নিয়ে কবিতা লেখা শুরু করেন, তখন সেসব কবিতা লুফে নিতে থাকেন সম্পাদকরা। এভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন কবি অ্যাডোনিস।

প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াইয়ের কথা তুলে ধরে এই কবি বলেন, “তখন কবিতা চর্চা তো একেবারে নিষিদ্ধ ছিল।সে সময় আমি কোরআন, আরবের লোকজ ঐতিহ্যগুলোকে নানা উপমায়, নানা ভঙ্গিতে কাব্যে উপস্থাপন করতে শুরু করলাম। লোকেরা ধর্মপ্রিয়, তাদের জন্য আমি তেমনভাবেই লিখতে থাকি। তখন লোকেদের সমস্যা ছিল ওরা পড়তেই চাইত না। তারা আমার কবিতা পড়া শুরু করল। লেবানন, সিরিয়া অঞ্চলে লোকেদের সাহিত্য চর্চা শুরু হল।”

অ্যাডোনিসের কাব্যে চরিত্র ‘মিহিয়া’ সাহিত্য অনুরাগী অনেকের কাছে পরিচিত। এই ‘মিহিয়া’ চরিত্রের মধ্য দিয়ে নিজের কথাগুলো অবলীলায় বলে গেছেন কবি।

চরিত্রটির বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাডোনিস বলেন, “মিহিয়া আসলে আমারই একটি রূপ। মিহিয়া মানবতার কথা বলে। রাজনৈতিক ভাষ্য দেয়, সমালোচনা করে। তার ভেতরে দিয়ে আবার আমি কবিতাকে ও সংস্কৃতিকে নতুন করে পড়ে নেওয়ার আহ্বান জানাই।”

তিনি বলেন, সুফি মতবাদের সঙ্গে রাজনীতির দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। দাই সুফিবাদের চর্চায় অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে তাকে।

“নিজের আলাদা পরিচয় গড়ে তোলা কিন্তু খুব সোজা কথা নয়। সে সময়ে সুফিবাদের চর্চা করতে গিয়ে আমাকে আধুনিক কাব্যসাহিত্যের দিকেও নজর রাখতে হয়েছে। গোটা বিশ্ব সাহিত্যের নানা উপাদানকে কীভাবে আরবি সাহিত্যে প্রবেশ করানো যায় তাই ভাবতাম।

“সে সময়ে যা হল, লোকেরা কবিতায় আল্লাহকে খুঁজে পেল, পেল লোকজ ঐতিহ্যের কথা। বাস্তব আর পরাবাস্তবের মধ্যে একটা যোগসূত্র স্থাপন করতে চেয়েছিলাম আমি। আরবি সাহিত্যের নানা ধারা বদলে দিয়ে আমি নতুন একটি ফর্ম নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম।”

নিজেকে বামপন্থি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন কবি অ্যাডোনিস।

তিনি বলেন, “আমার রাজনৈতিক আদর্শের মূল কথা হচ্ছে মানুষ। মানুষ তো কেবল সংখ্যাতত্ত্ব নয়, এই মানুষ হল পরিবর্তনের নিয়ামক। মানুষকে ঘিরেই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। আমি সারা জীবন সেই মানুষের সঙ্গে থাকতে চেয়েছি।”

ধর্মের ব্যবহারের কারণে রাজনীতি দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়ে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে ধর্ম ও রাজনীতি আলাদা নয়। এ দুটোকে এক করে ফেলা হয়। অথচ ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত চর্চার বিষয়। ধর্মকে অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে মেলানো ঠিক না। ”

তিনি বলেন, “সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে মানবাধিকার, নারী স্বাধীনতা ও মানুষের মুক্তচিন্তার ভিত্তিতে। ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন মেলানো ঠিক না। সমাজ গঠন করতে হবে মানবতার ভিত্তিতে।”

‘আরব বসন্ত’ নামে যে গণআন্দোলনের জোয়ারে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে সরকার পরিবর্তন হয় তার কঠোর সমালোচনা করেন কবি অ্যাডোনিস।

তিনি বলেন, “আমেরিকা তাদের নিজেদের প্রয়োজনে ‘আরব বসন্ত’ সৃষ্টি করেছিল। লিবিয়া ইরাক ইরানসহ আরব দেশগুলোর দারিদ্র্য দূর করার কথা থাকলেও সত্যিকার অর্থে অভাব দূর হয়নি। আমেরিকার রাজনীতির কারণেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে।”

কবি পরিচয়ের বাইরে অ্যাডোনিস একজন শিক্ষক। ইউনিভার্সিটি অব লেবাননের আরবি সাহিত্যের অধ্যাপক, পাশাপাশি দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ান তিনি।

কবিতার জন্য সর্বপ্রথম সিরিয়া-লেবাননভিত্তিক সেরা কবিতা সম্মাননা ‘নাজিম হিকমত পোয়েট্রি অ্যাওয়ার্ড’ পান কবি অ্যাডোনিস। এরপর ১৯৮২ সালে প্যারিসের এস্তেফান মালার্মে একাডেমির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১১ সালে জার্মানির গেটে পুরস্কার পান, পরে নরওয়েজিয়ান একাডেমি ফর লিটারেচার অ্যান্ড ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশনের ব্রনসন পুরস্কার, ব্রাসেলসে আয়োজিত আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবে সেরা কবির পুরস্কার পান তিনি।