৭ মার্চের ভাষণ: ইউনেস্কো ধন্যবাদ জানিয়ে সংসদে প্রস্তাব

একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অফ দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ যুক্ত হওয়ায় ইউনেস্কোসহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানিয়ে সংসদে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Nov 2017, 06:50 PM
Updated : 14 Nov 2017, 07:44 PM

মঙ্গলবার বাণিজ্যমন্ত্রী তোফয়েল আহমেদের আনা প্রস্তাবের উপর সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদসহ সরকারি, বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র ৫৮ জন সংসদ সদস্য ছয় ঘণ্টা আলোচনা করেন। শেষে রাত ১১টার দিকে প্রস্তাবটি সর্বস্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ বিধিতে প্রস্তাবটি তোলেন।

প্রস্তাবে তিনি বলেন, “সংসদের অভিমত এই যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার এ অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় দেশ ও জাতির সাথে আমরা গর্বিত। এজন্য ইউনেস্কোসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে জাতীয় সংসদ ধন্যবাদ জানাচ্ছে।”

প্রস্তাবের উপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “এই ভাষণের সঙ্গে আমাদের অস্তিত্ব ও ইতিহাস জড়িত। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ উজ্জীবিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, মনের ব্যথা বেদনা ছিল বাঙালি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করছিলেন, সেখানে যে পাকিস্তানিরা বাধা দিচ্ছিল, তা বুঝিয়েছিলেন।”

“জনগণের সঙ্গে তার যে আত্মার সম্পর্ক তা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি ১৯৪৮ সালে যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। এই সংগ্রামী পথ ধরে ৭ মার্চের ভাষণ ছিলো চরম মুহূর্ত। বাংলার মানুষ কী চায় তা ভাষণে তুলে এনেছিলেন এবং তিনি বাঙালি জাতির জন্য কী করতে চান, সেটাও ওই ভাষণে বুঝিয়ে দিয়েছেন।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তিনি ইতিহাস তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে অসহযোগ আন্দোলনে কী কী করতে হবে, তার নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। সেই সাথে গরিব মানুষের যেন কষ্ট না হয়, সেজন্য কোন কোন ক্ষেত্রগুলো মুক্ত থাকবে, তা বলেছেন। তার অবর্তমানে যেন তার নির্দেশগুলি মানা হয় সেই নির্দেশনাগুলো দিয়ে গেছেন। যেটা বাংলাদেশের মানুষ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। মুক্তিকামী মানুষ যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করেছে।”

“এই ভাষণটা প্রত্যেকটি লাইন যতবার পড়া যায়, মনে হয় এটা আবার নতুন করে পড়ছি। প্রতিটি বাক্যই কিন্তু একটা করে কোটেশন। প্রতিটি বাক্যই এদেশের মুক্তিকামী মানুষের জন্য যেমন প্রযোজ্য। এখনও কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম অব্যহত রয়েছে।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। অর্থনৈতিক মুক্তির পথে পা বাড়িয়েছিলেন তা সম্পন্ন করতে পারেননি। আমাদের দায়িত্ব সেটাই পালন করা। পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর এই ভাষণ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়ে গেল। যেখানে পাকিস্তানি সামরিক শাসক এই ভাষণ বন্ধ করতে পারেনি সেখানে ৭৫ এর পর বাংলাদেশে সেই ভাষণ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। তবে মুজিব সৈনিকদের থামিয়ে রাখতে পারেনি।”

“পৃথিবীতে মনে হয় কোন ভাষণ নেই যে প্রতিটি জেলা উপজেলা ওয়ার্ডে বারবার বেজেছে। কত হাজার বার যে এটা বেজেছে, তার হিসাব করাও কঠিন। মানুষ ৪৬ বছরে ধরে শুনছে। এটা এখনও পুরোনো হয়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্য একটি প্রজন্ম এই অমূল্য সম্পদক থেকে কিন্তু বঞ্চিত। ৭৫ সাল থেকে ৯৬ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এটা ঠিকই বাজিয়েছে। মনে হয়েছে, ওই সময়ে পাকিস্তানি প্রেতাত্মা দেশ চালিয়েছে। যে কারণে জাতির পিতার নাম, তার ভাষণ, সবই প্রায় বন্ধ ছিল। সব নষ্ট করে ফেলা হয়। কিন্তু ইতিহাস সত্যকে তুলে ধরবে। এটা হাজার চেষ্টা করলেও বন্ধ করা যায় না। সেটাই এই স্বীকৃতির মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে। পঁচাত্তরের পর এই তথ্যগুলো প্রায় ডেস্ট্রয় করা হয়। তবে রেডিওতে যারা চাকরি করেছিল তারা রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সংরক্ষণ করেছিল বলেই আমরা এটা পাই।”

ভাষণের পটভূমি তুলে ধরতে গিয়ে শেখ হাসিনা আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, “যেদিন স্বীকৃতির খবরটি এল মায়ের কথা বেশি বেশি মনে পড়ছিল। ৭ মার্চ ভাষণ হবে, সেখানে একটা ভাষণ দিতে যাচ্ছেন। কী বলবেন না বলবেন। অনেকেই অনেক কথা বলছেন। কেউ বলছেন এটা বলতে হবে। কেউ বলছেন ওটা বলতে হবে। বলে যাচ্ছেন। ঠিক আড়াইটার সময় মিটিংয়ে যাওয়ার কথা। মিটিংয়ে যাওয়ার আগে আমার মা বাবাকে ডেকে নিয়ে বললেন কিছুক্ষণ রেস্ট নিও। আমি ছিলাম মাথার কাছে বসা। বসে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। মা  মোড়া নিয়ে কাছে বসলো। বাবাকে বললেন কতক্ষণ চোখবন্ধ করে শুয়ে থাকো। তোমার সামনে অনেক দায়িত্ব। বসে যে কথাটা তিনি বলছেন- অনেকে অনেক কিছু বলবে।  এদেশের মানুষের জন্য তুমি সারা জীবন সংগ্রাম করেছো। কত মানুষ রক্ত দিয়েছে। তোমার সাথে বহু মানুষও অত্যাচার সহ্য করেছে। এদেশের মানুষের কিসে ভালো কিসে মন্দ তা তোমার থেকে বেশি কেউ জানে না।

“সামনে বাঁশের লাঠি পেছনে বন্দুকের নল। এতগুলো মানুষের ভাগ্য তোমার ওপর। কাজেই তোমার মনে যে কথাটা আসবে তুমি সেই কথাই বলবে। মা ‍দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, তোমার কারও কথা শোনার দরকার নেই। তোমার মনে যে কথা আসবে। তুমি ঠিক সেই কথাই বলবে।”

বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় বলেন, “৭ মার্চের ভাষণের মর্মার্থ হচ্ছে, স্বাধীনতা আর স্বাধীনতা। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে আরেকবার বিশ্ব দরবারে সম্মানিত করলেন। বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগ আপনারা কুক্ষিগত করে রাখবেন না। বিশ্বের মাঝে ছড়িয়ে দিন। তাহলে তাকে আমরা জাতির জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব।”

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, “আজকে খলনায়ককে নায়ক বানানো হয়। খলনায়করা ক্ষমতায় এসে বারবার ইতিহাস বিকৃত করেছে, বঙ্গবন্ধুকে ছোট করেছে। বঙ্গবন্ধু হিমালয়ের মতো।

“খালেদা জিয়া, এরশাদ সাহেব থেকে শুরু করে অনেকে ক্ষমতায় ছিল। এই ভাষণ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। রেডিও-টিভিতে প্রচার হত না। ভয় হয়, আল্লাহ না করুক দানবের দল যদি আবার ক্ষমতায় আসে তবে ভাষণ আবার নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। দানবের দলকে পরাজিত করতে হবে।”

আলোচনায় অন্যান্যদের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক, নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, মৃনাল কান্তি দাস, জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, কাজী ফিরোজ রশীদ, ফখরুল ইমাম, জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল, স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী, তাহজীব আলম সিদ্দিকী, সংরক্ষিত আসনের সদস্য ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি প্রমুখ।