আলোচনা-সমালোচনায় বিচারপতি সিনহার ১০৩০ দিন

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২১ জন বিচারক প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাই প্রথম পদত্যাগ করলেন।

মাসুম বিল্লাহ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Nov 2017, 09:38 AM
Updated : 11 Nov 2017, 10:47 AM

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের তোপের মুখে ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর সেখানে থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন তিনি।

বঙ্গভবনের পক্ষ থেকে শনিবার বিচারপতি সিনহার পদত্যাগপত্র পাওয়ার কথা জানানো হয়।

স্বাধীনতার পর বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম বিচারপতি।

বাংলাদেশের ৪৭ বছরে এস কে সিনহাই ছিলেন প্রথম অমুসলিম প্রধান বিচারপতি।

২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন এস কে সিনহা। বয়স অনুযায়ী ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। তবে কার্যকাল শেষ হল মেয়াদের ৮১ দিন আগেই।

দায়িত্ব পালনের আগে থেকে নানা কারণে আলোচিত ছিলেন বিচারপতি সিনহা, পরেও নানা ঘটনায় হন আলোচিত।

বিচারপতি এস কে সিনহার প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ

 

যুদ্ধাপরাধের মামলার শুনানিতে একাত্তরে নিজের শান্তি কমিটিতে থাকার কথা তুলে ধরে আলোচিত হন বিচারপতি সিনহা। তবে তিনি একইসঙ্গে বলেছিলেন, শান্তি কমিটির ছদ্মাবরণে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছিলেন তিনি।

প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর বিচার বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করার অভিযোগ নানা সময় তুলেছিলেন তিনি। নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন প্রকাশ নিয়ে তার সঙ্গে সরকারের বিরোধও ছিল আলোচিত।

অবসরের পর রায় লেখা নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত সহকর্মী বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে তার বাদানুবাদ বিচারাঙ্গন ছাড়িয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও উত্তাপ ছড়ায়।

এরপর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ভাস্কর্য স্থাপন নিয়েও সরকারের সঙ্গে টানাপড়েন চলে বিচারপতি সিনহার।

তার শেষ বিতর্কের শুরু সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে, যা প্রথমে ছুটি এবং শেষে পদত্যাগে গিয়ে শেষ হয়।

চলতি ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ওই রায় প্রকাশের পর থেকে পাঁচ মাসেই ঘটে যায় সব ঘটনা।

রায়ের পর ঘটনাক্রম

৩ জুলাই ২০১৭: উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বহাল রেখে  রায় দেয় আপিল বিভাগ।

১ অগাস্ট, ২০১৭: আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এই রায়ে প্রধান বিচারপতি সিনহার ৪০০ পৃষ্ঠার পর্যবেক্ষণ থাকে।

৯ অগাস্ট, ২০১৭: রায়ের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে কঠোর সমালোচনাও করেন তিনি।

১০ অগাস্ট, ২০১৭: ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতির ‘অগ্রহণযোগ্য’ বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

১২ অগাস্ট, ২০১৭: প্রধান বিচারপতি সিনহার সঙ্গে দেখা করে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে দলীয় বক্তব্য জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

১৩ অগাস্ট, ২০১৭: রায় নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের।

১৬ অগাস্ট, ২০১৭: রায় নিয়ে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোচনা।

২২ অগাস্ট, ২০১৭: প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব ছাড়তে বিচারপতি এস কে সিনহাকে সময় বেঁধে দেয় আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা। তা না হলে তাকে অপসারণে আন্দোলনের হুমকি।

ছুটি নিয়ে বিচারপতি সিনহা বিদেশ যাওয়ার আগে প্রতিক্রিয়া জানান সাংবাদিকদের

২৪ অগাস্ট, ২০১৭: সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শুরুর আগে শেষ অফিস করেন বিচারপতি সিনহা।

২৪ অগাস্ট, ২০১৭: আদালতের কার্যক্রম চলাকালে বক্তব্য ভুলভাবে উদ্ধৃত না করতে সংবাদকর্মীদের প্রতি আহ্বান বিচারপতি সিনহার।

১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭: সুপ্রিম কোর্টে অবকাশর মধ্যে ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর বিদেশ সফরে ছিলেন এস কে সিনহা।

১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭: ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং তার কিছু পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে জাতীয় সংসদে প্রস্তাব গ্রহণ; বিচারপতি সিনহার তীব্র সমালোচনা।

৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭: সুপ্রিম কোর্টের ১৪ অক্টোবরের বিবৃতিতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গত ৩০ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতিদের ডেকে নিয়ে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে ‘১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ’ তুলে ধরেন।

১ অক্টোবর ২০১৭: বঙ্গভবনের ওই বৈঠক থেকে ফিরে পরদিন ১ অক্টোবর আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার, বিচারপতি ইমান আলী নিজেরা বৈঠক করে বিষয়টি নিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন।

এরপর তারা প্রধান বিচারপতির হেয়ার রোডের বাড়িতে গিয়ে এই বিষয়ে কথা বললে বিচারপতি সিনহা ‘দুর্নীতি, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনের’ওই অভিযোগগুলোর ‘গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা’ দিতে পারেননি বলে বিবৃতিতে বলা হয়।

২ অক্টোবর, ২০১৭: নানা নাটকীয়তার পর অসুস্থতাজনিত কারণ দেখিয়ে ৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর ছুটিতে যাওয়ার আবেদন বিচারপতি সিনহার। পরে আরেক আবেদনে ছুটির সময় বাড়িয়ে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছিল।

৬ অক্টোবর, ২০১৭: প্রধান বিচারপতির খোঁজ নিতে সুপ্রিম কোর্ট থেকে তার বাসায় যেতে চান বিএনপি সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে থাকা আইনজীবী সমিতির নেতারা। তবে পুলিশ তাদের গাড়ি আটকে দেয়।

১৩ অক্টোবর ২০১৭: ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় যান প্রধান বিচারপতি সিনহা। তার আগে সাংবাদিকদের বলেন, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা তিনি বিব্রত, শঙ্কিত।

১৪ অক্টোবর ২০১৭: সুপ্রিম কোর্টের বিরল বিবৃতি; প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ।

১১ নভেম্বর, ২০১৭: সিঙ্গাপুর দূতাবাসের মাধ্যমে পাঠানো এস কে সিনহার পদত্যাগপত্র পৌঁছায় বঙ্গভবনে।