প্রধান বিচারপতি সিনহার পদত্যাগ

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে ছুটি নিয়ে বিদেশ গিয়ে পদত্যাগপত্র পাঠালেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।

সাজিদুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Nov 2017, 07:20 AM
Updated : 11 Nov 2017, 12:37 PM

Also Read: শপথ নিলেন এসকে সিনহা

Also Read: ‘পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য’ কাজ করবেন বিচারপতি সিনহা

Also Read: বিচার বিভাগের ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাচ্ছে: প্রধান বিচারপতি

Also Read: অবসরের পর রায় লেখা সংবিধান পরিপন্থি: প্রধান বিচারপতি

Also Read: প্রধান বিচারপতিকে ‘কথা কম’ বলার পরামর্শ সুরঞ্জিতের

Also Read: প্রধান বিচারপতির আচরণ সংবিধানবিরোধী: শামসুদ্দিন চৌধুরী

Also Read: সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কেন: প্রধান বিচারপতি

Also Read: প্রধান বিচারপতির দুশ্চিন্তা

Also Read: পদত্যাগ করুন, নইলে আন্দোলন: হুমকি প্রধান বিচারপতিকে

Also Read: দুই অঙ্গ ব্যর্থ হলে বিচার বিভাগ নীরব থাকতে পারে না: প্রধান বিচারপতি

Also Read: আইনের শাসনের জন্যই আমাকে বলতে হচ্ছে: প্রধান বিচারপতি

Also Read: ‘বিব্রত, শঙ্কিত’ বিচারপতি সিনহার বিদেশযাত্রা

Also Read: বিচারপতি সিনহার পদে ফেরা হচ্ছে না, ইঙ্গিত অ্যাটর্নি জেনারেলের

Also Read: ‘একা উনি কীভাবে বিচার করবেন?’

Also Read: বিচারপতি সিনহার পদত্যাগপত্র এখনও আসেনি: কাদের

Also Read: বিচারপতি সিনহার পদত্যাগ: এখন কী হবে

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এনিয়ে ২১ জন প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করলেও পদত্যাগের ঘটনা এটাই প্রথম।

ফলে রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের একটির প্রধান ব্যক্তির এই পদত্যাগ ৪৭ বছরের বাংলাদেশকে নতুন একটি অভিজ্ঞতার মুখে দাঁড় করাল।

আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত যত প্রধান বিচারপতি এসেছিলেন, তার মধ্যে বিচারপতি সিনহাই একমাত্র ব্যক্তি যিনি অমুসলিম।

বিএনপি আমলের আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ এই ঘটনাটিকে ‘কলঙ্কজনক অধ্যায়’ আখ্যায়িত করে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে বলে মনে করলেও বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জল ঘোলা হওয়ার কোনো কারণ দেখছেন না।

২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার আগেই যুদ্ধাপরাধের একটি মামলার শুনানিতে একাত্তরে নিজের শান্তি কমিটির সদস্য থাকার কথা তুলে ধরে আলোচনায় আসেন বিচারপতি সিনহা; তবে তিনি বলেছিলেন, শান্তি কমিটির সদস্যের ছদ্মাবরণে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছিলেন তিনি।

তারপর প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়ে বিচার বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করার অভিযোগ নানা সময় তুলে আলোচনার জন্ম দেন তিনি। নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন নিয়ে তার সঙ্গে সরকারের সঙ্গে তার বিরোধ হয় আলোচিত।

অবসরের পর রায় লেখা নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত সহকর্মী বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে তার বাদানুবাদ বিচারাঙ্গন ছাড়িয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও উত্তাপ ছড়িয়েছিল।

এরপর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ভাস্কর্য স্থাপন নিয়েও সরকারের সঙ্গে টানাপড়েন চলে বিচারপতি সিনহার।

তার শেষ বিতর্কের শুরু সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে, যা প্রথমে ছুটি এবং শেষে পদত্যাগে গিয়ে শেষ হল। এক হাজারের বেশি দিন দায়িত্ব পালনের পর মেয়াদ শেষের তিন মাস আগে বিদায় নিলেন তিনি।

চলতি ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ষোড়শ সংশোধনীর আপিলের রায় প্রকাশের পর থেকে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় ছিলেন বিচারপতি সিনহা।

পরের মাসে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তাতে বিচারপতি সিনহার ৪০০ পৃষ্ঠার পর্যবেক্ষণ দেখে শুরু হয় ব্যাপক বিতর্ক। সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বর্তমানে আইন কমিশনের সদস্য বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকও বলেন, এই রায় ‘ভ্রমাত্মক’। 

ওই পর্যবেক্ষণে সংসদ ও সরকার এবং জাতির জনককে খাটো করা হয়েছে অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগের দাবি তোলে আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা; তবে বিএনপি প্রধান বিচারপতির পক্ষেই দাঁড়িয়েছিল।

সংসদে আলোচনা এবং তীব্র আক্রমণের প্রেক্ষাপটে খবর আসে প্রধান বিচারপতির ছুটিতে যাওয়ার।

নানা নাটকীয়তার মধ্যে ৩৯ দিন ছুটি নিয়ে গত ১৩ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ায় বড় মেয়ের কাছে যান বিচারপতি সিনহা।

সেখান থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে শুক্রবার কানাডায় ছোট মেয়ের বাড়িতে যাওয়ার আগে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে তার পদত্যাগের খবর আলোচনায় এলেও সরকারের পক্ষ থেকে তা নিশ্চিত করা হচ্ছিল না।

প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার অনুষ্ঠান

শনিবার সকালে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিচারপতি সিনহার পদত্যাগপত্র দেশে না পৌঁছার কথা বলেন; দুপুরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, তার কাছে কোনো খবর নেই।

তার কিছুক্ষণের মধ্যে বঙ্গভবন থেকে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার পদত্যাগপত্র পাওয়ার খবর নিশ্চিত করা হয়।

দুপুর সোয়া ১টায় রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনার পদত্যাগপত্র আজই বঙ্গভবনে এসেছে।”

বিচারপতি সিনহা ছুটিতে যাওয়ার পর আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্বভার দেন রাষ্ট্রপ্রধান মো. আবদুল হামিদ।

এখন বিচারপতি সিনহা পদত্যাগ করায় সংবিধান অনুসরণ করে বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞাই ওই দায়িত্ব পালন করে যাবেন বলে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন।

বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ ওঠার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।

সর্বোচ্চ আদালত জানায়, ওই সব অভিযোগের ‘গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা’ তিনি না দিতে পারায় সহকর্মীরা তার সঙ্গে এজলাসে বসতে নারাজ।

গত ১৩ অক্টোবর বিদেশ যাওয়ার আগে বিচারপতি এস কে সিনহা বলে গিয়েছিলেন, তিনি বিব্রত, শঙ্কিত

এর পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলে আসছিলেন, সহকর্মীরা বসতে না চাওয়ায় এস কে সিনহার প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ফেরা ‘সুদূর পরাহত’।

বিচারপতি সিনহা অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পর বিএনপি অভিযোগ করেছিল, তাকে জোর করে ছুটি দিয়ে বিদেশ পাঠানো হয়েছে।

পদত্যাগের পরও বিএনপি নেতা মওদুদ বলেছেন, বিচারপতি সিনহাকে পদত্যাগ করানো হয়েছে।

ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার আগে বিচারপতি সিনহা বাধ্য হওয়ার কথা অস্বীকার করলেও তিনি বলেন, ক্ষমতাসীনদের আচরণে তিনি বিব্রত, শঙ্কিত

অন্যদিকে জোর খাটানোর অভিযোগ নাকচ করে আসা আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলছেন, “বিদেশ থেকে তিনি (পদত্যাগ)পত্র পাঠিয়েছেন সেখানে আমরা তাকে জোর করব কোত্থেকে?”

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেন, “৫ বিচারপতি যেখানে সিনহা সাহেবকে অনাস্থা দিয়েছেন, সেখানে সরকারের কী দোষ?”

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নেওয়া অবৈধ ঘোষণার যে রায় নিয়ে এই ঘটনার শুরু, সেই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু করেছে সরকার। তার মধ্যেই সরে গেলেন বিচারপতি সিনহা।