রোহিঙ্গা ফেরতে মিয়ানমারের ‘চার শর্ত’

নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজিভাব দেখালোও চারটি শর্তের কথা বলেছে মিয়ানমার সরকার।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Nov 2017, 04:50 AM
Updated : 11 Nov 2017, 04:50 AM

ইয়াঙ্গুনে শুক্রবার ভারত-মিয়ানমার সম্পর্ক নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শরণার্থী বিষয়ে দেশটির এই অবস্থান প্রকাশ পায় বলে কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার জানিয়েছে।

সম্মেলনে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ইউ কিইয়াও জেয়া’র দেওয়া শর্তগুলোকে ‘কড়া’ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে ভারতীয় সংবাদপপত্রটির প্রতিবেদনে।

শর্ত চারটি হচ্ছে- যে সব রোহিঙ্গা এ দেশে দীর্ঘদিন বসবাসের প্রমাণপত্র দাখিল করতে পারবেন, স্বেচ্ছায় রাখাইনে ফিরতে চাইবেন, পরিবারের কেউ এ দিকে রয়েছেন তেমন প্রমাণ দেখাতে পারবেন এবং বাংলাদেশে জন্মানো শিশুগুলোর বাবা-মা উভয়েই মিয়ানমারের স্থায়ী বাসিন্দা প্রমাণিত হলে তবেই তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে।

প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যকার শরণার্থী সঙ্কটের বিষয়ে ভারত ইতোমধ্যে বলেছেন, মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ থেকে ফেরত নিতে হবে। একই অবস্থান বিশ্ব সম্প্রদায়েরও।  

কিন্তু বাংলাদেশে শরণার্থী জীবন কাটানো ১০ লাখ রোহিঙ্গা ফেরতে মিয়ানমারের কূটনীতিক যে শর্তগুলোর কথা বলছেন, তা পূরণ যে দুঃসাধ্য, তা কক্সবাজারে শরণার্থী শিবির ঘুরে আসা বিদেশি অনেক কূটনীতিকই স্বীকার করেছেন।

তারা বলছেন, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার পর প্রাণ বাঁচাতে যারা ভিটেমাটি ছেড়ে এসেছেন, তাদের কাছে নিজেদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে প্রমাণের কোনো নথি না থাকাটাই স্বাভাবিক।

কলকাতার ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ, ইয়াঙ্গুনের ভারতীয় দূতাবাস এবং মিয়ানমারের বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সম্মেলনেও বিষয়টি উঠে আসে।

এর উত্তরে ইউ কিইয়াও জেয়া বলেন, “স্কুলে পড়া, হাসপাতালে চিকিৎসা, চাকরির নথি- এ সবের মতো কিছু প্রমাণ তো দেখাতেই হবে। না হলে ফেরত নেওয়াটা মুশকিল।”

শরণার্থী সঙ্কটের বিষয়ে কেন এত কড়া শর্ত- তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, রাখাইন প্রদেশের এই সমস্যা কেবল মানবিক বিষয় নয়। নিরাপত্তাও একটা বড় কারণ।

রাখাইনে সমস্যা সমাধানে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নে এগিয়ে যাওয়াকে নিজেদের আন্তরিকতার প্রমাণ হিসেবে দেখিয়েছেন ইউ কিইয়াও জেয়া।

এদিকে নিউ লাইট অব মিয়ানমার খবর দিয়েছে, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মংডুতে নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) বিলি শুরু করেছে মিয়ানমার সরকার।

বাংলাদেশে শরণার্থী জীবনে রোহিঙ্গারা

১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুসরণ করে যাচাইয়ের মাধ্যমে কারা মিয়ানমারের নাগরিক, তা নিশ্চিত হয়ে এই এনভিসি দেওয়া হচ্ছে।

ওই আইনে মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করেনি মিয়ানমার, যা নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে বহু কাল ধরে রাখাইনে বসবাসরত এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর।

রোহিঙ্গারা যে রাখাইনের বাসিন্দা, ইতিহাস ঘেঁটে তার প্রমাণ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরা হলেও মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টিতে এরা ‘অবৈধ বাঙালি অভিবাসী’।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আসার শুরু ১৯৭৮ সালে; এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের মুখে শরণার্থী জীবনে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৪ লাখ ছাড়ায়।

গত ২৫ অগাস্ট রাখাইনে সেনা নির্যাতন শুরু হলে বাংলাদেশ পানে নামে রোহিঙ্গা ঢল; এই সংখ্যা আড়াই মাসে ৬ লাখ ছাড়িয়েছে।

গত মাসে মিয়ানমার গিয়ে অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল (ফাইল ছবি)

১৯৯২ সালে দ্বিপক্ষীয় এক চুক্তির আওতায় কিছু রোহিঙ্গা ফেরত গেলেও সঙ্কটের অবসান ঘটেনি। এবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনার মুখে মিয়ানমার শরণার্থী ফেরত নিতে রাজি হওয়ার কথা বললেও তাদের গড়িমসিভাব স্পষ্ট।

মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ে অক্টোবরের শুরুতে ঢাকায় এলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দুই দেশ একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের বিষয়ে সম্মত হয়।

ওই বৈঠকেই ১৯৯২ সালের যৌথ বিবৃতির বদলে নতুন একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এগিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলকে চুক্তির একটি খসড়াও হস্তান্তর করা হয়।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, যে প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালের চুক্তির নীতিমালা ও যাচাইয়ের প্রক্রিয়াগুলো ঠিক করা হয়েছিল, বর্তমান পরিস্থিতি তার তুলনায় অনেকটাই আলাদা। সুতরাং ওই চুক্তি অনুসারে এবার রোহিঙ্গাদের পরিচয় শনাক্ত করার প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয়।

এরপর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল মিয়ানমার সফর করে দেশের অবস্থান তুলে ধরে এলেও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে শরণার্থী ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রে টালবাহানা চলছে।