‘সুদূর পরাহত’

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে থাকা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ছুটি শেষ হলেও তার কাজে যোগ দেওয়ার বিষয়ে নতুন কোনো তথ্য নেই সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কাছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Nov 2017, 11:04 AM
Updated : 11 Nov 2017, 04:09 AM

প্রায় এক মাস অস্ট্রেলিয়ায় বড় মেয়ের কাছে কাটিয়ে বিচারপতি সিনহা সিঙ্গাপুর হয়ে কানাডায় ছোট মেয়ের কাছে রওনা হয়েছেন বলে খবর এসেছে কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে। কানাডা ও সিঙ্গাপুরে প্রবাসী দুজন সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমও একই ধরনের তথ্য পেয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য আসেনি।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, প্রধান বিচারপতির ছুটি বাড়ানোর কোনো তথ্য তার জানা নেই। সেক্ষেত্রে শনিবার থেকে তিনি ‘অনুপস্থিত’ বলে বিবেচিত হবেন এবং রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে ব্যবস্থা নেবেন।

আর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আগের মতোই বলেছেন, তার বিশ্বাস, বিচারপতি সিনহার দায়িত্বে ফেরা ‘সুদূর পরাহত’। 

প্রধান বিচারপতি শেষ অফিস করেন সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শুরুর আগে গত ২৪ অগাস্ট। ৩ অক্টোবর আদালত খোলার আগের দিন সরকারের তরফ থেকে তার ছুটিতে যাওয়ার কথা জানানো হয়। এরপর ১৩ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন তিনি।

সে সময় আইন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ছুটিতে প্রধান বিচারপতির বিদেশে অবস্থানের সময়ে, অর্থাৎ ২ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত, অথবা তিনি ‘দায়িত্বে না ফেরা পর্যন্ত’ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা প্রধান বিচারপতির কার্যভার সম্পাদন করবেন।

২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পাওয়া বিচারপতি সিনহার চাকরির মেয়াদ রয়েছে আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। সংবিধান অনুযায়ী পদত্যাগ না করলে বা অপসারণ না করা হলে ওই সময় পর্যন্ত তিনিই বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি থাকবেন।

৩৯ দিনের দীর্ঘ ছুটি শেষে বিচারপতি সিনহা দায়িত্বে ফিরছেন কি না জানতে যোগাযোগ করা হলে সুপ্রিম কোর্টের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার জেনারেল জাকির হোসেন বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, এ বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।

আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে উনার (প্রধান বিচারপতি) ছুটির বিষয়ে নতুন কোনো তথ্য নেই। তিনি যদি ছুটি বাড়িয়ে না নেন বা কিছু না জানান, তাহলে চলতি ছুটির পর তা অনুপস্থিতি হিসেবে গণ্য হবে।”

সেক্ষেত্রে সাংবিধানিক কোনো জটিলতা ঘটবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “একেবারেই না, এক্ষেত্রে সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা নিবেন। সেখানে ‘অনুপস্থিতির’ বিষয়টি বলা আছে।”

সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দিয়ে থাকেন রাষ্ট্রপতি।

ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে প্রধান বিচারপতি তাহার দায়িত্বপালনে অসমর্থ বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে ক্ষেত্রমত অন্য কোনো ব্যক্তি অনুরূপ পদে যোগদান না করা পর্যন্ত কিংবা প্রধান বিচারপতি স্বীয় কার্যভার পুনরায় গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারকের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণতম, তিনি অনুরূপ কার্যভার পালন করিবেন।”

শুক্রবার ছুটি শেষেও প্রধান বিচারপতি ‘অনুপস্থিত’ থাকলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কার নেতৃত্বে চলবে- সে নির্দেশনা রাষ্ট্রপতি ইতোমধ্যে দিয়ে রেখেছেন। 

ছুটি শেষে বিচারপতি সিনহা দেশে ফিরছেন কি না- সে বিষয়ে নানা জল্পনা কল্পনার মধ্যেই শুক্রবার প্রথম আলো, ইত্তেফাক, কালের কণ্ঠসহ কয়েকটি পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে তার সিঙ্গাপুর হয়ে কানাডার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার খবর আসে। পত্রিকাগুলো প্রধান বিচারপতির ‘ঘনিষ্ঠ’ ও ‘নির্ভরযোগ্য’ সূত্রের বরাত দিয়ে ওই খবর প্রকাশ করে।

সিঙ্গাপুর থেকে একজন সাংবাদিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রধান বিচারপতি অস্ট্রেলিয়া থেকে আগেই সিঙ্গাপুরে এসেছেন এবং শুক্রবার কানাডার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন বলে তিনিও শুনেছেন। কিন্তু সিঙ্গাপুরের বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে মুখ খোলেননি।

আর কানাডা প্রবাসী আরেক সাংবাদিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, সিঙ্গাপুর থেকে রওনা হয়ে প্রধান বিচারপতি বাংলাদেশ সময় শনিবার ভোরের দিকে টরন্টো পৌঁছাবেন বলে তিনি শুনেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের কানাডা মিশনও এ বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়নি।

প্রধান বিচারপতি ছুটি বাড়ানোর কোনো আবেদন করেছেন কি না জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, “এ সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারব না। আমি শুধু এতটুকু জানি যে, উনার পক্ষে আদালতে ফিরে এসে এজলাসে বসে কাজ করা সুদূর পরাহত।”

বিচারপতি সিনহা বাদে আপিল বিভাগে এখন বিচারক আছেন ৫ জন। নৈতিক স্খলন ও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে প্রধান বিচারপতির ‘গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা’ না পাওয়ায় তার সঙ্গে এজলাসে বসতে তারা অস্বীকৃতি জানিয়েছেন বলে সুপ্রিম কোর্টের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। 

অগাস্টের শুরুতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকেই ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে ছিলেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।

সংবিধানের ওই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু রায়ে তা বাতিল করে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনে সুপ্রিম কোর্ট।

সাত বিচারপতির ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেওয়া ৭৯৯ পৃষ্ঠার ওই রায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নিজের পর্যবেক্ষণের অংশে দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন।

ওই রায় এবং পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে ‘খাটো করা হয়েছে’ অভিযোগ তুলে বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলেন ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা।

তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে প্রধান বিচারপতি গত ৩ অক্টোবর থেকে ছুটিতে যান। তিনি দায়িত্বে না ফেরা পর্যন্ত আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির কার্যভার দেওয়া হয়।

প্রধান বিচারপতিকে ‘জোর করে’ ছুটিতে পাঠানো হয়েছে- বিএনপির এমন অভিযোগের মধ্যেই ১৩ অক্টোবর রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন বিচারপতি সিনহা।

যাওয়ার আগে তিনি বলে যান, তিনি ‘অসুস্থ নন’, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় ‘বিব্রত’। তার বিশ্বাস, সরকারের একটি মহল রায় নিয়ে ‘ভুল ব্যাখ্যা’ দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী তার ওপর ‘অভিমান’ করেছেন।

প্রধান বিচারপতি দেশ ছাড়ার পরদিনই সুপ্রিম কোর্টের বিরল এক বিবৃতিতে বলা হয়, বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, আর্থিক অনিয়ম, অর্থ পাচার ও নৈতিক স্খলনসহ ১১টি সুনির্দিষ্ট গুরুতর অভিযোগ জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।

সহকর্মীরা এর ব্যাখ্যা চাইলে গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা বিচারপতি সিনহা দিতে পারেননি- এ কারণে তারা অভিযোগের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত একই বেঞ্চে বসতে রাজি নন বলে জানানো হয় বিবৃতিতে।

আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত ১৮ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে, তার অনুসন্ধান হবে এবং তা দুদকের মাধ্যমে করা হতে পারে।