এসব কী শুরু হল: প্রশ্ন ফাঁসে ক্ষুব্ধ অভিভাবক

পরীক্ষার আগের রাতে শিক্ষার্থীদের নাওয়া-খাওয়া ভুলে বইয়ে মুখ গুঁজে রাখার যে চিত্র এতকাল ধরে দেখে আসছে সবাই, এখন তা বদলে যাওয়ার খবর দিলেন চলমান জেএসসিতে এক পরীক্ষার্থীর অভিভাবক।

কাজী নাফিয়া রহমানও সাজিয়া আফরিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Nov 2017, 06:01 PM
Updated : 16 Nov 2017, 12:37 PM

সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ হাই স্কুলের এই পরীক্ষার্থীর মা রাবেয়া খানম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “আমার ছেলের এক বন্ধু শুনেছি সারারাত জেগে বসে ছিল প্রশ্ন পাওয়ার আশায়।”

শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে কেন্দ্রের এক পরীক্ষার্থীর মা সালমা রহমান কোচিং সেন্টারগুলোকে দায়ী করে বলেন, “বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের শিক্ষকরা বাচ্চাদের আগের রাতে বলে রাখে সকালে ফেইসবুকে প্রশ্ন দেওয়া হবে। আর সেকারণেই বাচ্চারাও অপেক্ষা করে থাকে, কখন প্রশ্ন পাবে তারা।”

এবার জেএসসি পরীক্ষা শুরুর পর থেকে আলোচনায় প্রশ্ন ফাঁস। একটানা কয়েকটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মিলছে ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে।

বৃহস্পতিবার সাধারণ বিজ্ঞান পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে ঢাকার তিনটি কেন্দ্রে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের তিন প্রতিবেদক দেখেছেন বইয়ের বদলে স্মার্টফোন নিয়ে শিশু পরীক্ষার্থীদের ব্যস্ততা।

শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে প্রশ্নের জন্য মোবাইল ফোনে চোখ দুই পরীক্ষার্থীর

কারণ একটাই প্রশ্নপত্র পাওয়া; সকাল ৯টার দিকে প্রশ্ন পাওয়ার পর উত্তর খুঁজে ১০টার মধ্যে পরীক্ষার হলে ঢোকে তারা।দুপুর ১টায় বেরিয়ে আসার পর এই শিক্ষার্থীদের হাসিমুখ বলে দেয়, মিলে গেছে পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল কেন্দ্রে পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে এক ছাত্র বলে, “প্রশ্ন সকালেরটাই আসছে। গত তিন দিনসহ আজকেরটা হুবহু মিলে গেছে।”

কোথায় পেয়েছ- জানতে চাইলে এই কিশোর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, “মেসেঞ্জার গ্রুপ আছে, নম্বর দিছে, এখন ৫০০ টাকা পাঠাইতে হবে।”

মতিঝিল মডেল হাই স্কুলের এক শিক্ষার্থীও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে প্রশ্ন পাওয়ার সরল স্বীকারোক্তি দেয়।

 

“হ্যাঁ, আমরা প্রশ্ন পেয়েছি। বন্ধুরা পেয়েছিল প্রথমে, আমাদের সকালে দিয়েছে। সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যেই প্রতিদিন প্রশ্ন চলে আসে। নেটে মেসেঞ্জারে বা হোয়াটস অ্যাপে প্রশ্ন আর উত্তরের ছবি চলে আসে। আজকের প্রশ্ন পেয়েছি ৯টা ১০ এ।”

এসব দেখে শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের এক পরীক্ষার্থীর অভিভাবক নিলুফার আক্তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, “এসব কী শুরু হল?”

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিদিনই তো প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। অনেক বাচ্চাদের দেখা যায়, ৯টার পর থেকেই ওরা মোবাইল ফোনে প্রশ্ন দেখতে থাকে। এভাবে এক শিক্ষার্থী থেকে আরেক শিক্ষার্থীর হাতে চলে যায় এ প্রশ্ন।”

সকাল ৯টা থেকে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ, শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় ও মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ কেন্দ্রের সামনে দেখা যায় একই চিত্র। তিনটি স্থানেই বেশ কিছু পরীক্ষার্থীর জটলা ছিল মোবাইল ফোন ঘিরে।

শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে অভিভাবকরা

অনেক শিক্ষার্থীর পাশে অভিভাবকরাও দাঁড়িয়ে ছিল। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ কেন্দ্রে ঢোকার আগে এক পরীক্ষার্থীকে তার অভিভাবকের হাতে স্মার্টফোনটি দিয়ে যেতে দেখা গেল।

ফোনে কী দেখে তারপর কেন্দ্রে ঢুকল আপনার মেয়ে- জানতে চাইলে ওই অভিভাবক বলেন, “প্রশ্ন নাকি পেয়েছে, চোখ বুলিয়ে গেল।”

সাংবাদিক পরিচয় জানার পর এই ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, “ও পড়ে এসেছে এমনিতেই, তাও এত সহজে পেলে কি আর না দেখে থাকতে চাইবে?” 

সাংবাদিক পরিচয় জানার পর কাছে এসে সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ হাই স্কুলের শিক্ষার্থীর মা রাবেয়া খানম বলেন, “সারা বছর দিন রাত এক করে পড়ে আমার বাচ্চাটা, অনেকে কিছুই পড়ে না...শুনি প্রশ্ন পায়। অথচ তারা আমার ছেলের থেকে নম্বর বেশি পাবে।”

আরেক ব্যক্তি সাংবাদিক পরিচয় জেনে কাছে এসে বলেন, “শুনেছি নেটে প্রশ্ন পাওয়া যায়। সবাই প্রশ্ন পেয়েই পরীক্ষা দেয়, তো আমার মেয়ে খুব বিরক্ত করে এগুলো শুনে, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে বসে ছিল টাকা দিতে চাইনি বলে।”

পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস আগেও হয়েছে, তা নিয়ে প্রতিবাদও কম হয়নি। তাতেও বন্ধ হয়নি তা। অন্যবার আগের রাতে প্রশ্ন পাওয়া গেলেও জেএসসিতে প্রশ্ন মিলছে পরীক্ষার এক ঘণ্টা আগে।

শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীর মা সালমা রহমান প্রশ্ন ফাঁসের জন্য শিক্ষকদের সঙ্গে অভিভাবকদেরও দায়ী করেন।

“আমরা সবাই তো প্রশ্ন ফাঁসের জন্য দায়ী করি শিক্ষামন্ত্রীকে। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী কি প্রশ্ন ফাঁস করে?"

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ পরীক্ষা শুরুর ঠিক আগে প্রশ্ন ফাঁসের জন্য দুষছেন শিক্ষকদের

পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে কেন্দ্রে ঢোকার নিয়ম থাকলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষুব্ধ এই অভিভাবক।

তিনি বলেন, “৯টা ৫৫ এও অনেক স্টুডেন্ট হলে ঢুকছে। তাদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে কেন? এসব কারণেই বন্ধ হচ্ছে না প্রশ্ন ফাঁস।”

অভিভাবকদের এই প্রতিক্রিয়ায় মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের কেন্দ্র সচিব ড. শাহান আরা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাড়ে ৯টায় আমরা গেইট খুলি। বাচ্চারা যদি সবাই না ঢুকে যায়, কতজনকে ধরে ধরে আনা যায়? সাড়ে ৯টার মধ্যে ঢোকার নিয়ম থাকলেও নানা অজুহাতে বাচ্চারা আসে না। আমাদের এই ব্যাপারে আসলে কিছুই করার নেই। এখানে যা করার, তা সরকারকে করতে হবে।”

শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের সচিব এ ই এম আবদুল মান্নানও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এ বিষয়টিতে খুব কঠোর। তারপরও কিছু শিক্ষার্থী বলে যে পথে দেরি হয়েছে। তখন আমরা তাদের সে সুযোগটা দিই।”

শিক্ষক শাহান আরা বেগম অভিভাবকদেরও দায়ী করে বলেন, “তারা বাচ্চাদের অসততা শেখাবে কেন?”

অভিভাবকদের সামনেই প্রশ্নের সন্ধানে মোবাইল ফোনে চোখ শিশু শিক্ষার্থীদের। শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের চিত্র

বেআইনি কাজে শিশু শিক্ষার্থীদের প্ররোচিত করার এই অভিযোগের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সবাই প্রশ্ন পেয়েই পরীক্ষা দিচ্ছে, তো আমার মেয়েকে কেন পিছিয়ে রাখব?”

পরীক্ষা শুরুর আগে স্মার্টফোন নিয়ে হুড়োহুড়ি করা শিক্ষার্থীদের ভিড়ের মধ্যে বইয়ে মুখ গুঁজে পরীক্ষা হলে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। যাদের ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই।

এই দলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ক্ষুব্ধ হওয়ার পরও বলেন, “আমি তো আমার ছেলেকে অসততার শিক্ষা দিতে পারি না। তাহলে পরীক্ষা পাস করে গেলেও বড় হয়ে সে কী হবে? অসৎই তো হবে, না কি?” 

প্রশ্নের জন্য মোবাইলে নয়, শেষ মুহূর্তে বইয়ে চোখ রাখার চিরায়ত এই চিত্রও রয়েছে চলমান জেএসসি পরীক্ষায়

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদক চলমান জেএসসি পরীক্ষার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র এবং ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার প্রশ্নপত্রও ফেইসবুকের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে পান, যা মূল প্রশ্নপত্রের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।

তথ্যপ্রমাণসহ তখনই ঘটনাটি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকারকে জানানো হয়েছিল; তখন তিনি বিষয়টি বিটিআরসিকে জানাবেন বলে জানিয়েছিলেন।

বৃহস্পতিবার সাধারণ বিজ্ঞানের প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার খবর জানানো হলে তপন কুমার সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপনারা জানিয়েছেন আমরা সে অনুযায়ী বিটিআরসিকে বলেছি ব্যবস্থা নিতে। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও কাজ করছে। দেখা যাক কী হয়।”

শিক্ষক শাহান আরা বেগম বলছেন, প্রশ্ন ফাঁসকারীদের খুব সহজেই ধরা সম্ভব।

“এনএসআই বা প্রশাসনের যাদের কাজে লাগানো যায় তাদের কাজে লাগালেই এসব বের করে ফেলা সম্ভব। সরকার চাইলেই পারে।”

এই অবস্থার অবসান দ্রুত ঘটানো প্রয়োজন বলে মনে করেন এই শিক্ষক। “এভাবে চলতে থাকলে আসলে পরীক্ষা নেওয়া আর না নেওয়া একই কথা,” বলেন তিনি।

অভিভাবক রাবেয়া খানমও বলছেন এই প্রশ্ন ফাঁস থামানো দরকার এখনই।

“দেখুন আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ, বর্তমান কীভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে!”