পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে প্রশ্ন মিলছে মোবাইলে

রাজধানীর শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ৯টায় গিয়ে দেখা গেল, পেছনের গেইটের পাশের চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে ৪/৫জন শিক্ষার্থী তাদের স্মার্টফোনে কী জানি খুঁজছেন।

কাজী নাফিয়া রহমান সাজিয়া আফরিন ও রিফাত রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Nov 2017, 12:08 PM
Updated : 9 Nov 2017, 02:31 PM

কী নিয়ে এই ব্যস্ততা- জানতে চাইলে এই কিশোরদের সরল স্বীকারোক্তি আসে, প্রশ্ন খুঁজছেন তারা।

সোয়া এক ঘণ্টা পর জেএসসির যে সাধারণ বিজ্ঞান পরীক্ষাটি হবে, তার প্রশ্নপত্র স্মার্টফোনের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুঁজছিলেন তারা।

কিছুক্ষণ পর সকাল ৯টা ৫ মিনিটে এই পরীক্ষার্থীদের চোখেমুখে খুশিখুশিভাব ফুটে ওঠে; জানা গেল, প্রশ্ন পেয়েছেন তারা, সঙ্গে উত্তরও রয়েছে।

এরপর পরীক্ষা কেন্দ্রটিতে আসা অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের কাছে ছড়িয়ে পড়ে উত্তরসহ প্রশ্নপত্র, নিয়ম অনুযায়ী যা তাদের পাওয়ার কথা ছিল কেন্দ্রের ভেতরে শিক্ষকদের মাধ্যমে এবং তা আরও ৫৫ মিনিট পর।

পরীক্ষা হলে ঢোকার আগে ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া এ প্রশ্ন-উত্তর অনেক শিক্ষার্থীকে কাগজে ও হাতে লিখে নিতে দেখা যায়। সন্তানের জন্য বেআইনিভাবে এই প্রশ্ন পেতে কয়েকজন অভিভাবককেও তৎপর দেখা যায়।

প্রশ্ন পেয়ে তা দেখিয়ে দিচ্ছেন এক অভিভাবক; শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের চিত্র

এই পরীক্ষা কেন্দ্রে এবার পরীক্ষা দিচ্ছেন হাজী আশরাফ আলী উচ্চ বিদ্যালয়, লায়ন্স অগ্রগতি শিক্ষা নিকেতন, আগারগাঁও তালতলা কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়, শেরে বাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

এ প্রশ্ন পরীক্ষায় আসবে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে হাজী আশরাফ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী (শিশু বলে নাম প্রকাশ করা হল না) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার প্রশ্ন তো মেসেঞ্জারে পেয়েছি। ওগুলো সবই তো কমন পড়েছে। এটাও কমন পড়বে।”

সৃজনশীল প্রশ্নগুলো পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগে পেলেও খুব একটা লাভ হয় না বলে মন্তব্য এই শিক্ষার্থীর; কিন্তু নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন নিয়েই আগ্রহ বেশি তার।

পরীক্ষা শুরুর আগে যে প্রশ্নগুলো হাতে নিয়ে এই শিক্ষার্থীর ভারহীন হওয়া যে অমূলক ছিল না, তার প্রমাণ মেলে তিন ঘণ্টা পর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার মূল প্রশ্নপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসার পর।

শিক্ষার্থীদের কাছে যে বহুনির্বাচনী প্রশ্ন দেখা গেছে পরীক্ষা শুরুর আগে, মূল প্রশ্নপত্রের সঙ্গে তার হুবহু মিল পাওয়া যায়।

আর এসব দেখে নিলুফার আক্তার নামে এক অভিভাবকের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ছিল- “এসব কী শুরু হল?”

প্রশ্নের জন্য মোবাইলে নয়, শেষ মুহূর্তে বইয়ে চোখ রাখার চিরায়ত এই চিত্রও রয়েছে চলমান জেএসসি পরীক্ষায়

এভাবে এবার জেএসসির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রায় প্রতিদিনই ফাঁস হচ্ছে এবং ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রেই পরীক্ষা দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের এক পরীক্ষার্থীর মা নিলুফার আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিদিনই তো প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। অনেক বাচ্চাদের দেখা যায়, ৯টার পর থেকেই ওরা মোবাইল ফোনে প্রশ্ন দেখতে থাকে। এভাবে এক শিক্ষার্থী থেকে আরেক শিক্ষার্থীর হাতে চলে যায় এ প্রশ্ন।”

এক পরীক্ষার্থী জানান, তারা কাছের এলাকা শেওড়াপাড়ার ‘টেকনিক কোচিং’ সেন্টার থেকে পাচ্ছেন জেএসসির প্রশ্ন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ কোচিং সেন্টারের এক শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোচিং এর ভাইয়ারা তো এসএসসির প্রশ্নও দিছেন। ওগুলা তো সব পরীক্ষায় আসছে। সবার রেজাল্ট ভালোও হয়েছে। এজন্যই তো প্রশ্ন নিচ্ছি।”

কয়েকজন অভিভাবকও বলেন, ‘টেকনিক কোচিং সেন্টার’ থেকে প্রশ্ন পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে মোবাইল ফোনে প্রশ্ন পাওয়ার পর উত্তর হাতে লিখে নিচ্ছে পরীক্ষার্থী

মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ কেন্দ্রেও পরীক্ষার্থী বেশ কয়েকজনের হাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দেখা যায়।

সকালে ওই কেন্দ্রের সামনে গিয়ে দেখা যায়, মোবাইল হাতে শিক্ষার্থীদের জটলা। উচ্ছ্বসিত হয়ে  প্রশ্ন মিলিয়ে দেখছেন কেউ কেউ, কেউ হাতে উত্তর লিখে নিচ্ছেন। এসব শিক্ষার্থীদের পাশে অভিভাবকরাও ছিলেন।

সকাল ৯টা থেকে শুরু করে ১০টা পর্যন্ত মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের বাইরের ফুটপাতেও জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত দেখা যায় পরীক্ষার্থীদের। কী দেখছ- প্রশ্নের জবাবে মতিঝিল মডেল হাই স্কুলের এক ছাত্র বলেন, “প্রতিদিন পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে যা দেখি।”

অনেক শিক্ষার্থীর পাশে অভিভাবকও দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি বলেন, “প্রশ্ন নাকি পেয়েছে, চোখ বুলিয়ে গেল।”

সাংবাদিক পরিচয় জেনে ওই অভিভাবক তার পরিচয় গোপন করে বলেন, “ও পড়ে এসেছে এমনিতেই, তাও এত সহজে পেলে কী আর না দেখে থাকতে চাইবে!”

বিজ্ঞান পরীক্ষার ‘ক’ সেট ‘অয়োময়’ নামের একটি প্রশ্ন পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে শিক্ষার্থীদের মোবাইলে পড়তে দেখা যায়। দুপুর ১টায় পরীক্ষা শেষ হলে পরীক্ষার আগে পাওয়া প্রশ্নের সঙ্গে মূল প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া যায়।

মতিঝিল মডেল হাই স্কুলের কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, তারা প্রশ্ন পেয়েছেন।

 

একজন বলেন, “বন্ধুরা পেয়েছিল প্রথমে, আমাদের সকালে দিয়েছে। সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যেই প্রতিদিন প্রশ্ন চলে আসে। নেটে মেসেঞ্জারে বা হোয়াটস অ্যাপে প্রশ্ন আর উত্তরের ছবি চলে আসে। আজকের প্রশ্ন পেয়েছি ৯টা ১০ এ।”

ফেইসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপ থেকে প্রশ্ন পাওয়ার পর ৫০০ টাকা পাঠাতে হয় বলেও জানায় এই পরীক্ষার্থী।

অধিকাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, তারা এ প্রশ্নগুলো মেসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে পাচ্ছেন তাদের ‘কোচিং সেন্টারে’র শিক্ষকদের কাছ থেকে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এক প্রতিবেদক চলমান জেএসসি পরীক্ষার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র এবং ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার প্রশ্নপত্রও ফেইসবুকের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে পান, যা মূল প্রশ্নপত্রের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।

অভিভাবকদের সামনেই প্রশ্নের সন্ধানে মোবাইল ফোনে চোখ শিশু শিক্ষার্থীদের। শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের চিত্র

তথ্যপ্রমাণসহ তখনই ঘটনাটি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকারকে জানানো হয়েছিল; তখন তিনি বিষয়টি বিটিআরসিকে জানাবেন বলে জানিয়েছিলেন।

বৃহস্পতিবার সাধারণ বিজ্ঞানের প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার খবর জানানো হলে তপন কুমার সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপনারা জানিয়েছেন আমরা সে অনুযায়ী বিটিআরসিকে বলেছি ব্যবস্থা নিতে। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও কাজ করছে। দেখা যাক কী হয়।”

যেসব কেন্দ্রের সামনে প্রশ্নপত্র পাওয়া যাচ্ছে, সেসব কেন্দ্রের নাম জেনে নেন তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছ থেকে, প্রশ্ন ফাঁস প্রতিরোধে সহযোগিতাও চান।

একটি কোচিং সেন্টারের কথা জানালে তপন সরকার তার ঠিকানা জেনে নেন এবং রোববার সকালে কেন্দ্রগুলোতে তারা কাজ করবেন বলে জানান।

শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের সচিব এ ই এম আবদুল মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা ১৫ মিনিট আগে প্রশ্নের বক্সটি খোলেন। কেননা বিভিন্ন তলার কক্ষগুলোতে প্রশ্নগুলো পৌঁছাতে হয়।

শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের সচিব এ ই এম আবদুল মান্নান

প্রশ্নফাঁসকে ‘জঘন্য অপরাধ’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “এর ফলে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”

দেরিতে পরীক্ষার হলে ঢোকার বিষয়ে মান্নান বলেন, “আমরা এ বিষয়টিতে খুব কঠোর। তারপরও কিছু শিক্ষার্থী বলে যে পথে দেরি হয়েছে। তখন আমরা তাদের সে সুযোগটা দিই।”

পরীক্ষার্থীরা যেন কোনো অসদুপায় অবলম্বন করতে না পারে, সে কারণে তারা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মান্নান।

মোবাইল ফোনের বিষয়ে তিনি বলেন, “নিষেধ করা সত্ত্বেও যেসব শিক্ষার্থীরা মোবাইল নিয়ে আসে, তাদের মোবাইল ফোন আমরা জমা নিয়ে রাখি।”

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের কেন্দ্র সচিব ড. শাহান আরা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাড়ে ৯টায় আমরা গেইট খুলি। বাচ্চারা যদি সবাই না ঢুকে যায় কতজনকে ধরে ধরে আনা যায়? সাড়ে ৯টার মধ্যে ঢোকার নিয়ম থাকলেও আমাদের এই ব্যাপারে আসলে কিছুই করার নেই। এখানে যা করার, তা সরকারকে নিতে হবে।”