কাকরাইলে মা-ছেলে খুন পারিবারিক দ্বন্দ্বে, সন্দেহ পুলিশের

রাজধানীর কাকরাইলে ঘরে ঢুকে মা-ছেলে খুনে জড়িত কাউকে ২৪ ঘণ্টায় গ্রেপ্তার করতে না পারলেও পারিবারিক দ্বন্দ্বকে সামনে রেখে তদন্ত চালাচ্ছে পুলিশ।

কামাল তালুকদার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Nov 2017, 11:55 AM
Updated : 2 Nov 2017, 06:20 PM

এই সন্দেহের ভিত্তি হিসেবে নিহত নারীর স্বামীর একাধিক বিয়েকে কারণ দেখাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। ওই পরিবারের প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলেও পারিবারিক জটিলতার আঁচ পাওয়া গেছে।

বুধবার সন্ধ্যায় কাকরাইলে রাজমনি প্রেক্ষাগৃহের পশ্চিম দিকে রাজমনি কার সেন্টার ও বায়রা ডাটাবেইজ প্রতিষ্ঠানের মাঝের গলিতে আব্দুল করিমের বাড়িতে খুন হন তার স্ত্রী শামসুন্নাহার ও ছেলে সাজ্জাদুল করিম শাওন।

ব্যবসায়ী করিম তখন ঘরে ছিলেন না। তিনি গ্রোসারি ব্যবসা ছাড়াও এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রের প্রযোজনা ও পরিচালনায় যুক্ত বলে পুলিশ জানিয়েছে।

বাড়ির পঞ্চম তলার ফ্ল্যাটে ধারাল অস্ত্রের আঘাতে মা ও ছেলেকে হত্যা করা হয়। শামসুন্নাহারের লাশ শোবার ঘরে ছিল, সিঁড়িতে পড়ে ছিল শাওনের লাশ।

দুটি মৃতদেশের সুরতহাল প্রস্তুতকারী রমনা থানার এসআই আতোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শাওনের গলাকাটা ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। শামসুন্নাহারের থুতনি, বুক ও পেটে ছুরিকাঘাতের জখম।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। মামলাও হয়নি। নিহত শামসুন্নাহারের ভাই তাদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় এলে মামলা করা হবে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান।

হত্যাকাণ্ডের কারণ জানা গেছে কি না- জানতে চাইলে রমনা থানার ওসি মাইনুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু আব্দুল করিম তিনটি বিয়ে করেছেন। তাই পারিবারিক বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে তদন্ত কাজ করছি।”

তবে ব্যবসায়িকসহ অন্যান্য বিষয়ও ‘মাথায় রেখেছেন’ বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

নিহত শামসুন্নাহার ব্যবসায়ী করিমের প্রথম স্ত্রী। তার বড় দুই ছেলে বিদেশে থাকেন।

নিহত শাওন

হত্যাকাণ্ডের পর করিমের দ্বিতীয় স্ত্রী রয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার তার তৃতীয় স্ত্রীর খোঁজ পাওয়া যায় পুলিশের কাছ থেকে।

নয়া পল্টনের একটি বাসা থেকে শারমিন আক্তার মুক্তা নামে এক নারীকে বৃহস্পতিবার আটকের পর পুলিশ জানায়, তিনি করিমের তৃতীয় স্ত্রী।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার নাবিদ কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর চার বছর আগে তিনি মুক্তাকে বিয়ে করেন। হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুক্তাকে আটক করা হয়েছে।”

করিমের তিন স্ত্রীই ঢাকায় থাকেন জানিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা তার তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকেও খুঁজছি। তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”

হত্যাকাণ্ডের পর করিম, বাড়ির দারোয়ান নোমান এবং গৃহকর্মী রাশিদাকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।

নোমানের ভাষ্য, সন্ধ্যার পর এক ব্যক্তি ওই ভবন থেকে নামার সময় তাকে উপরে ঝামেলা হচ্ছে বলে গিয়েছিলেন। তখন তিনি উপরে গিয়ে লাশ দেখতে পান।

ওই সময় ঘরে থাকা রাশিদার দাবি, তিনি রান্নাঘরে কাজ করার সময় হঠাৎ বাইরে থেকে কেউ দরজা আটকে দিয়েছিল। পরে দারোয়ান নোমান ছিটকিনি খুলে দিলে তিনি বেরিয়ে আসেন। ততক্ষণে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে খুনিরা পালিয়ে গেছে।

ভবনের নিচে অফিস এবং পাশে করিমের আরেকটি ভবনের নিচে দরজি দোকান থাকলেও কেউ কিছু টের পায়নি।

রাজমনি ঈশাখা হোটেলের বিপরীত দিকে ওভারব্রিজের পাশের এই গলির ভবনে ঘটে হত্যাকাণ্ড

বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়ে আশপাশের ভবনগুলোর বাসিন্দাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় দেখা গেছে।

স্কুলপড়ুয়া একটি শিশুকে নিয়ে বেরিয়ে আসা পাশের ভবনের এক ব্যক্তি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে বলেন, “উনাদের পারিবারিক ঝামেলা আছে।”

কী ঝামেলা আছে- জানতে চাইলে কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যান তিনি।

যে ভবনে খুন হন শামসুন্নাহার ও শাওন, তার নিচে প্রধান ফটকের সামনে বৃহস্পতিবার দুপুরে ঝাড়ু দিতে দেখা যায় নুরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে।

তিনি জানান, এই স্থানে প্রতিদিন জোহর, আসর ও মাগরিব নামাজ তিনি পড়ান; তাতে অংশ নেন আশপাশের বিভিন্ন অফিসের কর্মীরা।

বুধবার মাগরিবের নামাজ পড়িয়ে চলে যাওয়ায় খুনের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান নুরুল।

করিমের দুটি ভবনের নিচেই কলাপসিবল গেইট আছে, তবে অফিস থাকার কারণে সেগুলো প্রায় সর্বক্ষণই থাকে খোলা। এই বিষয়টি তুলে ধরে হত্যাকাণ্ডের পর নিরাপত্তাহীনতার ভোগার কথা জানান এক ভাড়াটিয়া।

খুনের পর বাড়ির সামনে পুলিশ

দারোয়ান থাকার কথা বলা হলে তিনি বলেন, “দুটি ভবনের একজনই দারোয়ান নোমান। সে তো শুধু দারোয়ানগিরিই করে না, ভাড়া ওঠানো থেকে শুরু করে বাড়িওয়ালার বাজারও করে।”

এক ভাড়াটিয়া বলেন, “উনারা (করিম) বড়লোক। ঢাকায় তিন চারটি বাড়ি ছাড়াও শ্যামপুরে আড়ত আছে। তিনটি বিয়ে করেছেন। তৃতীয় স্ত্রীর ভাইদের সঙ্গে ঝামেলার কথাও শুনেছি।”

পুলিশ কর্মকর্তা নাবিদ কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, করিমের প্রথম স্ত্রীর ঘরে তিন ছেলে, তালাকপ্রাপ্ত দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে এক ছেলে রয়েছে। তৃতীয় স্ত্রী মুক্তার কোনো সন্তান নেই।

মুক্তার ভাইয়ের সঙ্গে বাড়ি বা জমিসংক্রান্ত কোনো বিরোধ ছিল কি না- জানতে চাইলে নাবিদ কামাল সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, “সবগুলো বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত করা হচ্ছে।”

ঢাকার বাড্ডায় বৃহস্পতিবার একটি বাড়িতে বাবা-মেয়ে খুন হয়েছেন। সেখানে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় সাংবাদিকদের বলেন, “দুটি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই। তবে দুটি হত্যাকাণ্ডেই পারিবারিক ক্ষোভ-কলহ, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা বা সম্পর্কের টানাপোড়নের ঘটনা থাকতে পারে বলে আমার মনে হয়েছে।”