রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান রিলিফে হবে না: খালেদা

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান রিলিফ দিয়ে হবে না মন্তব্য করে সঙ্কট উত্তরণে কূটনৈতিক আলোচনার ওপর জোর দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপাসন খালেদা জিয়া।

সুমন মাহমুদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Oct 2017, 09:40 AM
Updated : 30 Oct 2017, 05:41 PM

সোমবার কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়ে তিনি সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করেন এবং ‘মানবতার খাতিরে’ রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

খালেদা বলেন, “আমরা মনে করি, রিলিফ সমস্যার সমাধান নয়, সমস্যার সমাধান হতে পারে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এবং কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে। সে দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে, তাদের সেখানে নিরাপদে ও নির্ভয়ে থাকতে দিতে হবে।”

সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে পালিয়ে আসা চার লাখের মতো রোহিঙ্গা গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে। আর গত ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নতুন করে দমন অভিযান শুরুর পর ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে।

মিয়ানমার সরকারের উদ্দেশে খালেদা বলেন, “মানবতার স্বার্থে আপনারা আপনাদের দেশের মানুষকে নিজেদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন এবং তাদের সেখানে নিরাপত্তা ও নাগরিকত্বসহ থাকার ব্যবস্থা করবেন।”

আর রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে, সেজন্য সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার আহ্বান জানান তিনি।

“রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এবং তাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে আপনারা অবিলম্বে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করুন। সরকারকেও জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে বলব। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এই দায়িত্ব নিতে হবে।… শুধু কথা বললে হবে না, এটা কাজের মাধ্যমে দেখিয়ে দিতে হবে।”

সোমবার দুপুরে কক্সবাজার থেকে উখিয়ায় পৌঁছে প্রথমে ময়নার গোনা রোহিঙ্গা শিবিরে যান বিএনপি চেয়ারপারসন। সেখানে ত্রাণ বিরতণের পর তিনি সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন।

লন্ডন থেকে গত ১৮ অক্টোবর দেশে ফেরার পর জনসম্মুখে প্রথম বক্তৃতা দিতে এসে সরকারের সমালোচনাও করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

তিনি বলেন, “এই সরকারের যেভাবে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানো উচিৎ ছিল, সেভাবে তারা দাঁড়াতে পারেনি। বরং যারা কাজ করতে চায়, তাদের পথেও নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করছে।”

‘রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিন রাখা সম্ভব নয়’

বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়ায় বাংলাদেশকে যে চাপের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, সে প্রসঙ্গ টেনে খালেদা বলেন, “আমাদের এখানে নানা কারণে রোহিঙ্গাদের রাখা সম্ভব নয়। রোহিঙ্গারা পরিবেশ নষ্ট করছে, গাছ কাটছে এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। দীর্ঘ দিন আমাদের পক্ষে এটা বহন করা সম্ভব নয়।”

 

তারপরও এ দেশের মানুষ রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ গরিব, এটি একটি ছোট দেশ। এদেশের মানুষের মন আছে, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আছে। সেজন্য তারা গরিব হয়েও নিজের পকেট থেকে যে যেভাবে পারছে তাদের (রোহিঙ্গা) সাহায্য করছে, তাদের কষ্ট ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।”

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে এবং ১৯৯২ সালে নিজের সরকারের সময়ে নেওয়া পদক্ষেপগুলোও তুলে ধরেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

কিন্তু এবারের সঙ্কটে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ‘কার্যকর কোনো উদ্যোগে এখন পর্যন্ত নেয়নি’ বলে মন্তব্য করেন বিএনপিনেত্রী।

ভারতসহ যেসব দেশ রোহিঙ্গাদের দুর্দশায় সমবেদনা জানালেও মিয়ানমারের সেনা অভিযানকে সমর্থন দিয়েছে, তাদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, “শুধু নিন্দা করলে হবে না, উপরে উপরে সহানুভূতি দেখালেও হবে না। সামনে শীত আসছে, তাই রোহিঙ্গাদেরকে তাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে হবে, যাতে রোহিঙ্গারা, তাদের শিশুরা সেখানে নিরাপদে থাকতে পারে।”

বিএনপি চেয়ারপারসন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাওয়ার আগেই দলের পক্ষ থেকে ১০ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের জন্য ৪৫ ট্রাক ত্রাণ সামগ্রী ত্রাণ বিতরণ কাজের সমন্বয়ে থাকা সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ত্রাণ বিতরণে সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, “সেনাবাহিনীকে আমি ধন্যবাদ জানাব, তারা সুন্দরভাবে রিলিফ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। বিএনপির নেতা-কর্মী ও উখিয়ার জনগণকেও ধন্যবাদ জানাব, তারাও রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মিডিয়াকেও আমি ধন্যবাদ জানাব।”

কান্না থামাতে শিশুকে কোলে

শরণার্থী শিবিরে এক শিশুর কান্না থামাতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে তাকে নিজের কোলে টেনে নেন খালেদা জিয়া।

দুপুরে ময়নার গোনা রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাণ বিতরণের পর রোহিঙ্গা নারীদের সঙ্গে কথা বলার সময় এই ঘটনা ঘটে।

একটি ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে থাকা একদল নারীকে দেখে বিএনপি চেয়ারপারসন এগিয়ে গিয়ে বলেন, “আপনারা কেমন আছেন?”

শিশুপুত্র মোবারককে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমিরা বলেন, “ন খাইয়ে, পাহাড়-পর্বত আডি আডি আসছি। ওনেরার দেশ আইসি। আর বেডা(স্বামী) মাইরেজ্জে।”

এ সময়ে আমিরার ছেলেটি কাঁদতে থাকলে খালেদা জিয়া সান্ত্বনা জানানোর এক পর্যায়ে তাকে কোলে তুলে নেন। আদর করে আবার মায়ের কাছে ফেরত দেন শিশুটিকে। এসময় খালেদা জিয়াকে বেশ আবেগপ্রবণ দেখাচ্ছিল।

খালেদা জিয়া ময়নার গোনা রোহিঙ্গা শিবির থেকে হাকিমপাড়া ও বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যান। পরে বালুখালীর পানবাজারে স্থাপন করা ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) মেডিকেল ক্যাম্পে গিয়ে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা শিশু ও প্রসূতির জন্য চিকিৎসা সামগ্রী হস্তান্তর করেন।

বিএনপি নেতাদের মধ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল নোমান, বরকত উল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু, আমানউল্লাহ আমান, এজেডএম জাহিদ হোসেন, গোলাম আকবর খন্দকার, জয়নুল আবদিন ফারুক, আবদুস সালাম, মাহবুবউদ্দিন খোকন, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, ফজলুল হক মিলন, নাজিমউদ্দিন আলম, শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, মাহবুবুর রহমান শামীম, শামা ওবায়েদ, আবদুস সালাম আজাদ, স্থানীয় সাবেক সাংসদ লুৎফর রহমান কাজল, হাসিনা আহমেদ, কক্সবাজার জেলা সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক শামীম আরা স্বপ্না এ সময় খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন।

অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের মধ্যে ছিলেন সাইফুল আলম নীরব, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, শফিউল বারী বাবু, আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েল, রাজিব আহসান, আকরামুল হাসান, কাজী আবুল বাশার, বজলুল বাসিত আনজু ও আহসান উল্লাহ হাসান।

রোহিঙ্গাদের দেখতে শনিবার সড়ক পথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এবং রোববার রাতে কক্সবাজার আসেন খালেদা। রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে সোমবার সন্ধ্যায় তিনি কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের পথে রওনা হন। রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে তিনি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে পৌঁছান। 

মঙ্গলবার সকালে ঢাকায় ফিরবেন তিনি। পথে তার দেড় ঘন্টা ফেনীতে যাত্রাবিরতি রয়েছে।