রোহিঙ্গা সঙ্কট: টিলারসনের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ 

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের নেওয়া পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। 

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Oct 2017, 04:25 PM
Updated : 27 Oct 2017, 04:25 PM

পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “আমরা বিষয়টি খুবই ইতিবাচকভাবে নিয়েছি।”

রাখাইনে সহিংসতা বন্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার যে আহ্বান টিলারসন জানিয়েছেন, তাকে বাংলাদেশ ‘আন্তর্জাতিক চাপ’ হিসেবেই দেখছে বলে জানান শহীদুল।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংকে ফোন করে ওই আহ্বান জানান।

পাশাপাশি পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সহযোগিতা চান তিনি।

পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র হেদার নাউয়ার্ট এক বিবৃতিতে বলেন, “এই সঙ্কটের কারণে বাস্তুচ্যুত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা যাতে নিরাপদে তাদের ঘরে ফিরতে পারে, সেজন্য নতুন কোনো শর্ত না দিয়ে ১৯৯২ সালের বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ বিবৃতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।”

মিয়ানমার সরকার আগেই জানিয়েছে, ১৯৯২ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় রোহিঙ্গাদের তারা ফেরাতে রাজি।

কিন্তু ওই চুক্তি এখন আর ‘বাস্তবসম্মত নয়’ জানিয়ে একটি নতুন প্রস্তাব দিয়ে মিয়ানমারের জবাবের অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শহীদুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“হ্যাঁ, এখনকার পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। তবে আমরা মনে করি, ১৯৯২ সালের সমঝোতা যে প্রিন্সিপাল মেনে হয়েছিল, তাকে ভিত্তি ধরে এবারও আলোচনা এগিয়ে নেওয়া যায়।”

রাখাইনে কয়েকশ বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস থাকলেও ১৯৮২ সালে আইন করে তাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাই রোহিঙ্গাদের বর্ণনা করে আসছেন ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ ও ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে।

সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে পালিয়ে আসা চার লাখের মত রোহিঙ্গা গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে। আর গত ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নতুন করে দমন অভিযান শুরুর পর ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে।

বেশ কিছুদিন কূটনৈতিক আলোচনার পর ১৯৯২ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি  প্রত্যাবাসন চুক্তি করে, যেখানে রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমার সমাজের সদস্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

ওই চুক্তির আওতায় মিয়ানমার সে সময় দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গাকে দেশে ফিরিয়ে নেয়। চুক্তি নির্ধারিত যাচাই প্রক্রিয়ায় আরও ২৪১৫ জন শরণার্থীকে সে সময় মিয়ানমার থেকে আসা বলে চিহ্নিত করা হলেও মিয়ানমার তাদের আর ফিরিয়ে নেয়নি।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনার মধ্যে গত ১৯ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে সু চি বলেন, ১৯৯২ সালে করা প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় ‘যাচাইয়ের মাধ্যমে’ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রাখাইনের মুসলমানদের ফিরিয়ে নিতে তার দেশ প্রস্তুত।

এর ধারাবাহিকতায় সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ে অক্টোবরের শুরুতে ঢাকায় এলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দুই দেশ একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের বিষয়ে সম্মত হয়।

ওই বৈঠকেই ১৯৯২ সালের যৌথ বিবৃতির বদলে নতুন একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এগিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলকে চুক্তির একটি খসড়াও হস্তান্তর করা হয়।

গত ৯ অক্টোবর ঢাকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, যে প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালের চুক্তির নীতিমালা ও যাচাইয়ের প্রক্রিয়াগুলো ঠিক করা হয়েছিল, বর্তমান পরিস্থিতি তার তুলনায় অনেকটাই আলাদা। সুতরাং ওই চুক্তি অনুসারে এবার রোহিঙ্গাদের পরিচয় শনাক্ত করার প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয়। এ কারণেই নতুন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকায় রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামে আগুনের ছবি ১১ সেপ্টেম্বরের।

১৯৯২ সালের ওই চুক্তির চতুর্থ দফায় রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা হয়, যাদের কাছে মিয়ানমারের জাতীয় পরিচয়পত্র বা জাতীয় নিবন্ধন কার্ড থাকবে, অথবা যারা জাতীয়তার পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য মিয়ানমার সরকারের যে কোনো দপ্তরের দেওয়া কোনো নথি দেখাতে পারবে এবং যারা মিয়ানমারে তাদের বসবাসের প্রমাণ দিতে পারবে- তাদের সবাইকে ধাপে ধাপে ফিরিয়ে নেবে মিয়ানমার।   

সে সময় মিয়ানমার সরকার বলেছিল, বাংলাদেশের আশ্রয়কেন্দ্রে সরকারিভাবে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা ওই যাচাই প্রক্রিয়ায় প্রত্যাবাসনের যোগ্য বিবেচিত হবে, ‘সহযোগিতার মানসে’ তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে।  

গত মাসে কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে আসা একজন কূটনীতিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, যে অবস্থায় এই মানুষগুলো মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে, তাতে তাদের কাছে পরিচয়পত্র আশা করা কঠিন।

তাছাড়া রোহিঙ্গাদের কাছে জাতীয় পরিচিতির যেসব কাগজপত্র ছিল, গতবছরই সেগুলো বাতিল করে দিয়েছে মিয়ানমার।   

“তারপরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চেষ্টা করলে কোনো একটি প্রক্রিয়া ঠিক করে দিতে পারে। আর রোহিঙ্গাদের বিষয়ে যাবতীয় কাগজপত্র তো মিয়ানমার সরকারের কাছে আছেই।”

রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট একটি এলাকায় রেখে তাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার। ইতোমধ্যে কক্সবাজারে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়েছে।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলেছে, এই নিবন্ধন পরে প্রত্যাবাসনেও কাজে লাগতে পারে।