‘অনুপ্রবেশকারীদের’ মিয়ানমারে ফেরাতে কাজ শুরু হয়েছে: কামালকে সু চি

রাখাইন থেকে যারা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকার কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন দেশটির নেত্রী অং সান সু চি।   

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Oct 2017, 05:30 AM
Updated : 27 Oct 2017, 05:57 AM

মিয়ানমার সফররত বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বুধবার সকালে নেপিদোতে দেশটির স্টেট কাউন্সিলর ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতা সু চির সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাদের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কথা হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের দশ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সকালে মিয়ারমারের নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। সেখানে ‘আন্তরিক পরিবেশে’ প্রায় এক ঘণ্টা তাদের মধ্যে কথা হয়। 

“অং সান সু চি বলেছেন, বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ফিরিয়ে নিতে তার সরকার কাজ শুরু করেছে। কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নেও তার সরকার কাজ করছে।”

অপু জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল বৈঠকে সু চিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।

“সু চি দুই দেশের সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফর করবেন বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছেন।”

ঠিক দুই মাস আগে রাখাইনের ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে সমন্বিত হামলার পর ২৫ অগাস্ট থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ওই অঞ্চলে নতুন করে সেনা অভিযান শুরু হয়; সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সীমান্তে শুরু হয় রোহিঙ্গাদের ঢল।

আট সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও রোহিঙ্গাদের আসা এখনও বন্ধ হয়নি। ইতোমধ্যে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে দমন-পীড়নের  মুখে পালিয়ে আসা আরও চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে গত কয়েক দশক ধরে।

রাখাইনে এবারের অভিযানে সেনাবাহিনী কীভাবে নির্বিচারে মানুষ মারছে, ধর্ষণ, লুটপাট করছে, সেই বিবরণ আসছে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কথায়।

স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলেছে, অভিযান শুরুর পর এক মাসেই রাখাইনে ২৮৮টি রোহিঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে; সেই বর্বরতা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

মিয়ানমারের নেত্রী সু চি সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে ‘সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই’ হিসেবে বর্ণনা করলেও জাতিসংঘ একে চিহ্নিত করেছে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ভাবছে। 

রাখাইনে কয়েকশ বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস থাকলেও  ১৯৮২ সালে আইন করে তাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাই রোহিঙ্গাদের বর্ণনা করে আসছেন ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ ও ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে। সু চি নিজেও কখনও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি বলেন না।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনার মধ্যে গত ১৯ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে সু চি বলেন, ১৯৯২ সালে করা প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় ‘যাচাইয়ের মাধ্যমে’ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রাখাইনের মুসলমানদের ফিরিয়ে নিতে তার দেশ প্রস্তুত রয়েছে।

এর ধারাবাহিকতায় সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ে অক্টোবরের শুরুতে ঢাকায় এলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দুই দেশ একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের বিষয়ে সম্মত হয়।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জন্য ওই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রস্তাব করে তার খসড়াও হস্তান্তর করা হয়েছিল। তবে সে বিষয়ে মিয়ানমারের জবাব এখনও জানা যায়নি।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার মধ্যেই দুই দেশের সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে পূর্ব নির্ধারিত বৈঠকে অংশ নিতে গত সোমবার মিয়ানমারে পৌঁছান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার বৈঠকগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টি আসছে। 

মঙ্গলবার দুপুরে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ দেশটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন কামাল। পরে তিনি টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আলোচনায় দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের কথা ওঠে। আমরা বলেছি, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করতে হবে।”

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা অপু জানান, গত দুদিনে সচিব ও মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেসব বিষয়ে বুধবার মিয়ানমারের নেত্রীকে অবহিত করেছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

“জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্তের বিষয়টিও তাকে জানানো হয়েছে। সু চি এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন।”

আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথাও সু চিকে বলেন।

“মন্ত্রী তাকে বলেছেন, আমাদের দেশে কোনো সন্ত্রাসী প্রশ্রয় পাবে না। তবে অনুপ্রবেশকারীদের দ্রুত ফিরিয়ে না নিলে এদের অনেকেই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে। তখন পরিস্থিতি বাংলাদেশ বা মিয়ানমার- কারও অনুকূলে থাকবে না বলে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে জানিয়েছেন,” বলেন অপু।

তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে ইয়াবার মত মাদক পাচার যে ভয়াবহ রূপ পেয়েছে, সে কথাও মন্ত্রী মিয়ানমারের নেত্রীর সামনে তুলে ধরেছেন।  

“সু চি তখন নিজেই বলেছেন, তার দেশের যুবসমাজও ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার বন্ধে তার সরকার সীমান্ত বন্ধ করবে।”