সংলাপ হল, ‘বড় চ্যালেঞ্জ’ সামনে

একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের সংলাপে নির্বাচনকালীন সরকার, বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েন, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ও ‘না’ ভোট চালু নিয়ে পাল্টাপাল্টি মত এসেছে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Oct 2017, 04:09 AM
Updated : 25 Oct 2017, 04:09 AM

বিশ্লেষকরা বলছেন, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্য নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ‘করার কিছু নেই’। কিন্তু দলগুলো সহায়তা না করলে কমিশনের একার পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করাও সম্ভব হবে না।

তারা বলছেন, কে এম নূরুল হুদার কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার আট মাসের মধ্যে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ শেষ করে স্বস্তিতে থাকলেও বড় চ্যালেঞ্জ সামনে।

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার মধ্যে দিয়ে গত ৩১ জুলাই ইসির সংলাপ শুরু হয়। এরপর ১৬ ও ১৭ অগাস্ট গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করে ইসি। ২৪ অগাস্ট থেকে ১৯ অক্টোবর ৪০টি দলের সঙ্গে আলোচনা শেষে ২২ ও ২৩ অক্টোবর নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও নারী নেত্রীদের সঙ্গে মত বিনিময় হয়।

আর সবশেষে মঙ্গলবার সাবেক সিইসি, ইসি ও সাবেক সচিবদের সঙ্গে বসে তাদের ভাবনাগুলো শোনে কে এম নূরুল হুদার কমিশন।

এই আলোচনায় শুধু ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের কাছ থেকেই ৫৩১টি সুপারিশ পেয়েছে ইসি। সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক, নারী নেত্রী ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের আরও দুই শতাধিক প্রস্তাব এসেছে।

আগামী বছরের শেষ দিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে দেড় বছরের একটি কর্মপরিকল্পনা ঠিক করেছে ইসি। সে অনুযায়ী সংসদীয় আসন সীমানা পুনর্বিন্যাস, আইন সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মতামত নিতেই তিন মাস ধরে সংলাপ চলে।

পাল্টাপাল্টি অবস্থান

সংলাপে আসা মতামত পর্যালোচনায় দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কোনো কথাই বলেনি। ‍বিএনপি চায় নির্দলীয় সহায়ক সরকার। আর জাতীয় পার্টি সংসদ ভেঙে দিয়ে অন্তর্ববর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়।

সেনা মোতায়েন নিয়ে আইনে বর্ণিত ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ারে’র কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও বিএনপির পক্ষ থেকে বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়নের দাবি এসেছে। জাতীয় পার্টিও ভোটের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী চায়।

আওয়ামী লীগ বর্তমান সংসদীয় আসন সীমানা বহাল রাখার পক্ষে বললেও বিএনপি চায় দেড়যুগ আগের সীমানায় ভোট হোক। আর জাতীয় পার্টি ভোটারের সংখ্যা অনুপাতে নতুন করে আসন বিন্যাস করতে বলেছে।

ইভিএম ও ‘না’ ভোট নিয়েও প্রধান তিন দলের অবস্থান বিপরীতমুখী।

নবম সংসদ নির্বাচনের সময়ের প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা মঙ্গলবার সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের বলেন, “সংলাপে এমন কিছু বিষয় এসেছে যেগুলো নিয়ে ইসির করার কিছুই নেই। কোনটা ইসির এখতিয়ারে আর কোনটা নয়, তা চিহ্নিত করতে হবে।”

সিইসি নূরুল হুদা ইতোমধ্যে বলেছেন, কোন প্রস্তাব ইসির এখতিয়ারে আছে, আর কোনটা নেই তা রাজনৈতিক দলগুলোও জানে। তারপরও তারা এসে সেসব প্রস্তাব সংলাপে দিয়ে গেছে। 

“সবার কথাই আমরা প্রতিবেদন আকারে সরকারের কাছে পাঠাব; রাজনৈতিক দলগুলোকেও পাঠাব। নানা ধরনের প্রস্তাব আছে… ইসি সব বাস্তবায়ন করতে না পারলেও এর প্রভাব সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছাবে।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে জন প্রত‌্যাশা পূরণ করতে হলে নূরুল হুদার কমিশনকে বেশ কিছু চ‌্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

এর মধ‌্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি চ‌্যালেঞ্জ হল কমিশন ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা ফেরানো এবং ২০১৯ সালের শুরুতে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

শামসুল হুদা বলেন, “নির্বাচন সুষ্ঠু করা ইসি একার পক্ষে সম্ভব নয়। পলিটিক্যাল পার্টিগুলোরও দায়িত্ব আছে। ইসিকে এখন কথা ও কাজে-কর্মে ফেয়ারনেস দেখাতে হবে, যাতে আস্থা নষ্ট না হয়। কিছুটা আস্থা তো হয়েছে, এটা ধারণ করতে হবে।”

আর সিইসি নূরুল হুদা বলেছেন, তার কমিশন এই সংলাপের মধ্যে দিয়ে সব পক্ষের কাছেই বার্তা পৌঁছে দিতে পারেবে বলে তার বিশ্বাস। 

“আমার তো মনে হয় সরকারের কাছে বার্তা পৌঁছবে; যারা বিরোধী দলে বা সংসদের বাইরে রয়েছে তাদের কাছেও তা পৌঁছে যাবে।  এর মাধ্যমে একটা প্রভাব পড়বে।”

তিন মাস ধরে চলা সংলাপের সার্বিক অগ্রগতি ও পরবর্তী করণীয় নিয়ে গণমাধ্যমকে জানাতে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে আসার কথা রয়েছে নূরুল হুদা ও তার কমিশনের।

আর যা যা এসেছে

মঙ্গলবার সংলাপ শেষে ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জানান, সবচেয়ে আলোচিত ওই পাঁচটি বিষয়ের বাইরেও বিভিন্ন বিষয়ে আরও বেশ কিছু মতামত এসেছে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে। 

সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, সকলের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচনের সময় সকল গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোকে কমিশনের অধীনে আনা, নির্বাচনের আগে ও পরে সন্ত্রাস দমনের ব্যবস্থা করা, একই মঞ্চে নির্বাচনী প্রচারের ব্যবস্থা করা, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা, নিবন্ধিত দলগুলোর পরামর্শ নিয়ে একটি জাতীয় ফোরাম করা, প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দেওয়া, অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা, সকল আইন বাংলায় করা, সংরক্ষিত নারী আসন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন প্রস্তাব রয়েছে এর মধ্যে।

ইসি ভারপ্রাপ্ত সচিব বলেন, “সংলাপে পাওয়া প্রস্তাবগুলো সংকলন করা হবে। এর মধ্যে যেগুলো নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত সেগুলো ইসি বিবেচনা করতে পারে। বাকিগুলো কমিশন দেখবে- কী করা যায়।”