পরীক্ষার ফলাফল প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ দেয় না: ঢাবি প্রশাসন

প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের দাবি উঠলেও প্রশাসন বলছে, পরীক্ষার ফলাফলের বিগত বছরের ধারাবাহিকতা রয়েছে, যা প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার প্রমাণ দেয় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Oct 2017, 06:08 PM
Updated : 23 Oct 2017, 03:26 AM

গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত এই পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের বিক্ষোভের মধ্যেই রোববার দুপুরে ফলাফল প্রকাশ করেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান।

তিনি বলেন, “এই পরীক্ষার ফল বিগত বছরগুলোর মতোই হয়েছে। তাই সন্দেহের ঊর্ধ্বে থেকে ফল প্রকাশ করা হয়েছে।”

২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয় ৭১ হাজার ৫৪৯ জন, তাদের মধ্যে ১০ হাজার ২৬৪ জন ভর্তিযোগ্য বিবেচিত হয়েছেন। অপরদিকে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে এই ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ৭৬ হাজার ৯৮৯ জন, তাদের মধ্যে পাস করেছিলেন ৭ হাজার ৫৬৬ জন।

দুই বারের পরীক্ষার ইংরেজি অংশের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত শিক্ষাবর্ষের তুলনায় এবার ইংরেজিতে ২ হাজার ৬৯৮ জন শিক্ষার্থী বেশি পাস করেছেন। তবে ১৫ নম্বরের বেশি পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা গতবার বেশি, ৪৬ জন।

পরীক্ষার আগের রাতেই ইংরেজি অংশের ২৫টির মধ্যে ২৪টি প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল বলে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়।

প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে রোববার দুপুরে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো

এই অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে কলা অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন ও ‘ঘ’ ইউনিটে ভর্তির সমন্বয়ক অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, “প্রশ্ন ফাঁসের চূড়ান্ত কোনো প্রমাণ আমাদের দিতে পারেনি। এটি একটি গুজব ছিল এরকম একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার।

“তারা দাবি করেছে, ইংরেজি অংশটি প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু যখন আমি ফলাফল তৈরি দেখি, এই ফলাফলে কোনো ধরনের প্রভাব নাই।”

উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইংরেজিতে ৮ থেকে ৯ নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, “যদি প্রশ্ন ফাঁস হত তাহলে ২৫ থেকে ৩০ নম্বর পেয়ে হাজারে হাজারে ছেলে-মেয়ে পাশ করে আসত।”

এবার ইংরেজিতে পাস করেছে অর্থাৎ পাস নম্বর ৮ থেকে ৩০ নম্বর পেয়েছে ১০ হাজার ২৬৪ জন। এদের মধ্যে  ৩০ নম্বর পেয়েছে দুইজন,  ২৮ পেয়েছে ১৪ জন, ৩০-২৫ নম্বর পেয়েছে ৯৮ জন, ২০ থেকে ২৫ নম্বর নিচে পেয়েছে ৫৭৯ জন, ১৫ থেকে ২০ নম্বর নিচে পেয়েছে ২ হাজার ৪২৮ জন এবং ১০ থেকে ১৫ নম্বর নিচে পেয়েছে ৪ হাজার ৭৩৬ জন।

আগেরবার ইংরেজিতে পাস করে ৭ হাজার ৫৬৬ জন। তাদের মধ্যে ৩০ নম্বর পেয়েছিল দুইজন,  ২৮ পেয়েছিল ১৫ জন। এছাড়া ৩০-২৫ নম্বর পেয়েছে ১১৯ জন, ২০ থেকে ২৫ নম্বর নিচে পেয়েছে ৬৫৯ জন, ১৫ থেকে ২০ নম্বর নিচে পেয়েছে ২ হাজর ৩৮৩ জন এবং ১০ থেকে ১৫ নম্বর নিচে পেয়েছে ৩ হাজার ৪২৯জন।

‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি কমিটির একজন সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রশ্ন ফাঁস হলে অনেকেই ভালো নম্বর পেত। ইংরেজি অংশের ২৫টি প্রশ্নের মধ্যে ২৪টি প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কথা গণমাধ্যমে এসেছে।

“তাহলে পরীক্ষায় ইংরেজিতে ২৮.৮ নম্বর তো হাজার হাজার শিক্ষার্থীর পাওয়ার কথা, কিন্তু তার প্রমাণ নেই। অথ্যাৎ প্রশ্ন পত্র ফাঁস হয়নি বলে তার প্রভাবও ফলে পড়েনি।”

‘ষড়যন্ত্র’ দেখছে প্রশাসন

শুক্রবার ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষা চলাকালে একটি কেন্দ্রে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান

‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করে দুপুর সোয়া ১টার দিকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে যান বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা।

ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ও ছাত্র ফেডারেশনের নেতাকর্মীরা সেখানে স্লোগান দেওয়ার এক পর্যায়ে তালা ভেঙে ভবনের ভেতরে ঢুকে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনের বারান্দায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন।

সেখানে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী বলেন, “ভর্তি পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব ও ঐহিত্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে লজ্জার।”

ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, প্রশ্ন ফাঁসের তথ্য পরীক্ষা শুরুর আগে কেন জানায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানোর দায়িত্ব সাংবাদিকদের না, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।” 

তাদের বিক্ষোভ-সমাবেশের এক পর্যায়ে প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানী গিয়ে সবাইকে সেখান থেকে সরিয়ে ভবনের মূল ফটকের সামনে নিয়ে আসেন।

সেখানে উপাচার্য আখতারুজ্জামান আন্দোলনরতদের বলেন, “অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ভালো। এটা ইতিবাচক দিক। তোমাদের মিছিলের শব্দ আমি শুনেছি, ভেবেছিলাম বের হয়ে কথা বলব। তার আগে গেইটের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছ, এটা ভালো নয়।”

প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ নাকচ করে তিনি বলেন, “কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পরীক্ষার দুই-তিন ঘণ্টা পর এমন অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়। কিছু কিছু তথ্য পাচ্ছি যে ছাত্রদের উস্কে দেওয়া হচ্ছে, এর কতগুলো প্রমাণও পেয়েছি। এর প্রেক্ষিতে একটি জিডি করেছি।

“সব কথা বলা যায় না, তবুও বলি, ছাত্রদের যে উস্কে দিচ্ছে তার প্রমাণ আছে।রাতে ই-মেইল করেছে কারা? যারা এরকম জাতির এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে, কেননা প্রশ্নটি ফাঁস হয় নাই, প্রশ্নটি আউট হয়েছে সকাল ১০টার পরে, তখন শিক্ষার্থীদের হাতে চলে গেছে।”

উপাচার্য বলেন, “গোয়েন্দাদের সাথে কথা বলেছি, প্রশ্নটিতে কিছু করা হয়েছে। এই প্রশ্নটা পরীক্ষার হলে থেকে যখন প্রশ্ন বিতরণ করেছি তারপর পেয়েছে। এটার প্রভাব পরীক্ষার ফলাফলের কোথাও পড়েনি। হাজার হাজার পরীক্ষার্থীর কথা চিন্তা করে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদার জন্য এ ধরনের রিপোর্টের ভিত্তিতে পরীক্ষা বাতিল করতে পারি না।”

এরপর বেলা আড়াইটার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান।

সে সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “প্রশ্ন ফাঁস হয়নি, পরীক্ষার পরে ২-৩টার দিকে কয়েকজন সাংবাদিক প্রশ্ন ফাঁসের কথা জানায়, আগে জানায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করতে একটি অশুভশক্তি এর পেছনে রয়েছে, আমরা তাদের তথ্য পেয়েছি, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

প্রক্টরের বিরুদ্ধে সাংবাদিককে ‘আটকে’ রাখার অভিযোগ

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে কথা বলে উপাচার্য কেন্দ্রীয় ভর্তি অফিসে চলে যান। স্লোগান দিতে দিতে ওই এলাকা থেকে সরে যায় শিক্ষার্থীরা। এরপর বেলা সোয়া ২টার দিকে কেন্দ্রীয় অনলাইন ভর্তি কমিটির অফিসে যাওয়ার সময় ইংরেজি দৈনিক ইনডিপেনডেন্টের প্রতিবেদক মীর আরশাদুল হককে উপাচার্যের অফিসে আটকে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আরশাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভর্তি কমিটির অফিসের দিকে যাওয়ার সময় সহকারী প্রক্টর সোহেল রানা সংবাদকর্মীদের দিকে মোবাইল ধরে ভিডিও করছিলেন। আমি ভিডিও করার কারণ জানতে চাইলে তিনি আমার পরিচয়পত্র দেখতে চান।পরিচয়পত্র দেখালে আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন তিনি।”

এরপর প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানী এসে তাকে উপাচার্যের কক্ষে নিয়ে আটকে রাখেন বলে অভিযোগ আরশাদের।

পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত অন্যান্য প্রতিবেদক এসে তাকে উদ্ধার করেন। আরশাদকে নিয়ে কেন্দ্রীয় অনলাইন ভর্তি কমিটির অফিসে গিয়ে উপাচার্যের কাছে প্রতিকার চাইলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। বিষয়টি দেখবেন বলেও সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেন অধ্যাপক আখতারুজ্জামান।