ঐশীর সাজা কমেছে যে পাঁচ কারণে

পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যায় দায়ে তাদের মেয়ে ঐশী রহমানকে দেওয়া হাই কোর্টের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় প্রকাশ করা হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Oct 2017, 03:21 PM
Updated : 22 Oct 2017, 03:32 PM

কৈশোর উত্তীর্ণ ঐশীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল বিচারিক আদালত,সেই সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের হাই কোর্ট বেঞ্চ।

গত ৫ জুন হাই কোর্টের রায় ঘোষণার সময় বলা হয়, পাঁচটি যুক্তি বিবেচনায় নিয়ে ঐশীর সাজা কমানো হয়েছে।

রোববার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রায়ে ওই পাঁচ কারণ উঠে এসেছে।

রায়ে বলা হয়েছে, তদন্তকালে ঐশীকে কোনো এক ব্যক্তি তার অতীত কৃতকর্ম নিয়ে ‘খারাপ উদ্দেশ্যে’ কিছু একটা বলেছিলেন, যে কারণে ঐশী আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল।

এছাড়া তদন্তে উঠে এসেছে, ঐশী যে নিজ হাতে তার মা-বাবাকে হত্যা করেছে সে ভয়ঙ্কর রাতের কথা সে তখনও চিন্তা করতে পারছিল না। এমন পরিস্থিতিতে তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো কি ন্যায়সঙ্গত হবে?

নিহত স্বপ্না বেগম ও তার স্বামী মাহফুজুর রহমান

এতে বলা হয়, ঐশীর অপরাধ ফৌজদারি আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য হলেও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে তাকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে করছে হাই কোর্ট।

এর পাঁচ কারণও রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে-

এক. মাদকাসক্ত ঐশী মানসিক বিচ্যুতির কারণে জোড়া খুনের ওই ঘটনা ঘটিয়েছে। বাবা-মাকে হত্যার পেছনে তার সুস্পষ্ট কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।

দুই. আসামি ঐশী অ্যাজমা, ওভারিয়ান সিস্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাদের পরিবারে মানসিক সমস্যার ইতিহাস রয়েছে। ঐশীর দাদি ও মামা আগে থেকেই মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। পরীক্ষা করে ঐশীর মধ্যেও সেই সমস্যা পাওয়া গেছে।

তিন. ঘটনার সময়টি ছিল ঐশীর সাবালকত্ব পাওয়ার মুহূর্ত। তখন তার বয়স ছিল ১৯ বছর।

চার. ওই হত্যাকাণ্ডের আগে ঐশী ফৌজদারি অপরাধ করেছেন, এমন কোনো নজির নেই।

পাঁচ. বাবা-মাকে হত্যার পর ঐশী পালিয়ে না গিয়ে স্বেচ্ছায় থানায় আত্মসমর্পণ করেন।

এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে, বাস্তবতা ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিচার করে হাই কোর্ট ঐশীর সাজা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।

রায়ের অভিমতে বলা হয়, ঐশীর বাবা পুলিশ বিভাগে ও মা ডেসটিনিতে চাকরি করতেন। জীবন জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তারা। এ কারণে তারা ঐশীকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেননি। তবে সন্তানকে সময় দেওয়ার প্রয়োজন যখন তারা উপলব্ধি করছিলেন, ততক্ষণে তার (ঐশী রহমান) জীবন আসক্তিতে ডুবে গেছে ও উচ্ছনে চলে গেছে।

রায়ে বলা হয়েছে, সামাজিক অবক্ষয় বিবেচনায় নিয়ে কিছুটা আবেগ প্রবণ হয়ে নিম্ন আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, একটা মেয়ে তার পিতা-মাতাকে নিজের হাতে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার সাহস দেখিয়েছে।

কিন্তু সাজা নির্ধারণ ও বিচারের ক্ষেত্রে এ ধরনের আবেগ প্রদর্শনের সুযোগ নেই। বিচারের ক্ষেত্রে আদালতকে আইনগত তথ্যাদি ও প্রমাণাদি বিবেচনায় নিতে হবে, যেখানে ১৯ বছর বয়সের একজন নারী এ ধরনের অপরাধ করেছে।  

২০১৩ সালের ১৬ অগাস্ট রাজধানীর চামেলীবাগে নিজেদের বাসা থেকে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের লাশ উদ্ধার করা হয়।

পরদিন ১৭ আগস্ট নিহত মাহফুজুর রহমানের ভাই মশিউর রহমান বাদী হয়ে পল্টন থানায় হত্যা মামলা করেন। ওই দিনই নিহত দম্পতির মেয়ে ঐশী রহমান পল্টন থানায় আত্মসমর্পণ করে বাবা-মাকে নিজেই খুন করার কথা স্বীকার করে।

এ মামলায় ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর ঢাকার একটি আদালত ঐশীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করে। হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতার দায়ে ঐশীর বন্ধু মিজানুর রহমান রনিকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তার আরেক বন্ধু আসাদুজ্জামান জনিকে খালাস দেওয়া হয়।

মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নয় মন্তব্য করে হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, “এটা কার্যকর করলেই যে সমাজ থেকে অপরাধ দূর হয়ে যাবে, তা নয়। অনেক সময় কম সাজাও সমাজ থেকে অপরাধ কমাতে সুস্পষ্টভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে।”