সাংবাদিকদের জন্য নতুন চাকরি আইনের খসড়া প্রকাশ

চাকরির ধরন ভিন্ন হওয়ায় সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও এবং অনলাইন গণমাধ্যমের কর্মীদের জন্য ‘গণমাধ্যম কর্মী (চাকরির শর্তাবলী)’ নামে নতুন আইন তৈরিতে হাত দিয়েছে সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকশহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Oct 2017, 05:45 PM
Updated : 18 Oct 2017, 05:57 PM

পাঁচ বছর পর পর এই আইনের অধীনে গণমাধ্যমকর্মীদের বেতন-ভাতা ঠিক করতে ওয়েজবোর্ড গঠন করবে সরকার। প্রয়োজন মনে করলে অন্তবর্তী মজুরির হার নির্ধারণ করতে পারবে এই ওয়েজবোর্ড।

প্রস্তাবিত আইনে কোনো গণমাধ্যমকর্মীকে সপ্তাহে (একদিন ছুটি বাদে অন্য ছয় দিন) ৪৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করালে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার জন্য আর্থিক সুবিধা দিতে হবে।

‘গণমাধ্যম কর্মী (চাকরির শর্তাবলী) আইন- ২০১৭’ এর খসড়া মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে আগামী ২৫ অক্টোবরের মধ্যে মতামত চেয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। ই-মেইলে as.press@moi.gov.bd মতামত জানানো যাবে।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশ এক বিবৃতিতে এই আইন প্রণয়নের উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও মতামত দেওয়ার সময় বাড়ানোর দাবি করেছে। 

তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (প্রেস) মিজান-উল আলম বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০০৬ সালের শ্রম আইন অনুযায়ী ওয়েজবোর্ড গঠন করা হয়। সেখানে সংবাদপত্রের কথা বলা থাকলেও ইলেকট্রনিক মাধ্যমের কথা বলা হয়নি।

“সাংবাদিকরা চান না শ্রমিক শব্দগুলো তাদের গায়ে থাকুক। এজন্য প্রিন্ট, অনলাইন, টেলিভিশন, রেডিওসহ সব ধরনের গণমাধ্যমের কর্মীদের জন্য আলাদা আইন করার চিন্তা-ভাবনা চলছে।”

শ্রম আইন অনুযায়ী সম্পাদক থেকে শুরু করে গণমাধ্যমের সবকর্মীই শ্রমিক হিসেবে অভিহিত হন।

নতুন আইন পাস হলে শ্রম আইন থেকে গণমাধ্যমকর্মীদের বাদ দেওয়া হবে কি না- এ প্রশ্নে যুগ্ম-সচিব মিজান বলেন, “কেবল খসড়া করেছি, মতামত আসবে তারপর খসড়া চূড়ান্ত হবে, দেখা যাক।”

নতুন আইন প্রণয়নের প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছে, “গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরির ধরন সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের চেয়ে ভিন্ন হওয়ায় এবং সময়ের পরিক্রমায় সংবাদপত্র জগতে বহুমাত্রিক পরিবর্তন হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।”

খসড়ায় যা আছে

প্রতিটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে কর্মী নিয়োগ ও এ সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় এই আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান চাইলে ‘পরিদর্শন কমিটির’ অনুমোদন নিয়ে নিজস্ব চাকরিবিধি করতে পারবে কিন্তু তাতে সরকার প্রদত্ত সুবিধার চেয়ে সুযোগ-সুবিধা কম হওয়া যাবে না।

ঢাকা মহানগরের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত বা যুগ্ম-সচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি পরিদর্শন কমিটি থাকবে। এই কমিটিতে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার একজন করে সাংবাদিক ও একজন করে মালিক প্রতিনিধি, তথ্য অধিদপ্তরের একজন প্রতিনিধি এবং চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের একজন প্রতিনিধি থাকবনে।

ঢাকা মহানগরের বাইরে জেলা প্রশাসক মনোনীত একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের পরিদর্শন কমিটি হবে।

এই পরিদর্শন কমিটির অনুমোদন ছাড়া নিজস্ব চাকরিবিধি কার্যকর করা যাবে না।

খসড়ায় বলা হয়েছে, পরিদর্শন কমিটির আদেশে সংক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি আদেশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে সরকারের কাছে আপিল করতে পারবেন, এই আপিলের ওপর সরকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

“নিয়োগের সময় সব গণামাধ্যমকর্মীকে অবশ্যই নিয়োগপত্র দিতে হবে। সেখানে পদের নাম, বেতনক্রম, নিয়োগের তারিখ ও ধরন ছাড়াও নিয়োগের শর্তাবলীর উল্লেখ থাকতে হবে।”

খসড়া অনুযায়ী, প্রতিটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে কর্মীদের কল্যাণের স্বার্থে ভবিষ্য তহবিল গঠন করতে হবে। এই তহবিল ট্রাস্টি বোর্ড দিয়ে পরিচালিত হবে, যেখানে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং গণমাধ্যম কর্মীদের সমান সংখ্যক প্রতিনিধিত্ব থাকবে।

“কোনো গণমাধ্যমকর্মীকে কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে ‍ন্যূনতম ৪৮ ঘণ্টা কাজ করতে হবে। ৪৮ ঘণ্টার অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার জন্য এই আইনের অধীনে প্রণীতব্য বিধি অনুযায়ী আর্থিক সুবিধা পাবেন।”

গণমাধ্যমকর্মীরা সপ্তাহে একদিন ছুটি পাবেন উল্লেখ করে খসড়ায় বলা হয়েছে, পূর্ণ মজুরিতে প্রতি বছর ১০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি পাবেন। তবে এই ছুটি না কাটালে তা পরের বছর ভোগ করা যাবে না।

“পূর্ণ মজুরিতে একজন কর্মচারী প্রতি ১১ দিনে একদিন ছুটি অর্জন করবেন যা অর্জিত ছুটি হিসেবে গণ্য হবে। তবে এই ছুটি ভোগ না করলে ছুটির হিসেবে জমা থাকবে এবং চাকরি শেষে এজন্য আর্থিক সুবিধা পাবেন।”

প্রত্যেক গণমাধ্যমকর্মী চাকরির মেয়াদের ১/১৮ অংশ সময় অর্ধ মজুরিতে অসুস্থতাজনিত ছুটি পাওয়ার অধিকারী হবেন। তবে রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের যথাযথ প্রত্যয়ন ছাড়া এই ছুটি মঞ্জুর করা যাবে না।

প্রত্যেক গণমাধ্যমকর্মী প্রতি বছর পূর্ণ মজুরিতে এককালীন বা ‍দুইবারে সর্বোচ্চ নয় দিন পর্যন্ত উৎসব ছুটি ভোগ করতে পারবেন। তবে এই ছুটির তারিখ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে নির্ধারিত হবে।

প্রস্তাবিত আইনের খসড়া প্রকাশ করে মতামত চেয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়

কোনো গণমাধ্যমকর্মীকে উৎসব ছুটির দিনে কাজ করালে প্রতি এক দিনের জন্য দুই দিনের মজুরি অথবা দুই দিনের বিকল্প ছুটি মঞ্জুর করা যাবে। প্রত্যেক নারী গণমাধ্যমকর্মী সরকারি বিধি মোতাবেক মাতৃত্বকালীন ছুটি পাবেন।

কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে কর্মরত যে কোনো গণমাধ্যমকর্মী এবং তার উপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্যরা ন্যূনতম প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ে যেভাবে নির্ধারিত হবে সেভাবে চিকিৎসা সুবিধা পাবেন বলে খসড়ায় বলা হয়েছে।

নির্ভরশীল বলতে স্বামী বা স্ত্রী, বিধবা মা, বাবা-মা, আইনত বৈধ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুত্র ও কন্যা যারা সঙ্গে থাকে এবং পুরোপুরি নির্ভরশীলদের বোঝানো হয়েছে।

গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোনো নারী কর্মীর সঙ্গে অশ্লীল বা অভদ্রোচিত আচরণ করলে ওই নারীর শালীনতা ও সম্ভ্রমের পরিপন্থি বলে গণ্য হতে পারে।

খসড়ায় বলা হয়েছে, সরকার এই আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত গণমাধ্যমকর্মী, কর্মচারী ও শ্রমিকদের জন্য বেতন-ভাতা নির্ধারণের জন্য প্রজ্ঞাপন দিয়ে ওয়েজবোর্ড গঠন করবে।

ওয়েজবোর্ডে একজন চেয়ারম্যান এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মরত গণমাধ্যম কর্মীদের সমান সংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হবে, যাদের সবাইকে সরকার নিয়োগ দেবে।

“বাজারদর, জীবনযাত্রার মান বিবেচনায় রেখে এই আইনের বিধান মোতাবেক সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দিয়ে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ওয়েজবোর্ড গঠন করা যাবে।”

ওয়েজবোর্ড সব গণমাধ্যমকর্মীদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ করবে উল্লেখ করে খসড়ায় বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে কাজের সুবিধায় সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও ও অনলাইন উপ-কমিটি গঠন করতে পারবে। এসব উপ-কমিটির কর্মপরিধি মূল ওয়েজবোর্ড নির্ধারণ করবে।

“ওয়েজবোর্ড প্রয়োজন মনে করলে সরকারের কাছে অন্তর্বর্তী মজুরির হার নির্ধারণের প্রস্তাব করতে পারবে এবং সরকার এই প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেজেট প্রকাশ করতে পারবে, যা সব গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিকের জন্য অবশ্য পালনীয়।”

এই আইন পাস হলে কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান থেকে বকেয়া আদায়ে সরকারের কাছে আবেদন করা যাবে। আবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বকেয়া পাওনার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হলে সরকার অথবা তার ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ পাওনার ব্যাপারে সার্টিফিকেট ইস্যু করবে। আদায়যোগ্য অর্থ ১৯১৩ সালের পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি আইন অনুযায়ী আদায় করা হবে।

শ্রম আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বিচারযোগ্য কোনো মামলা বা অভিযোগ অথবা অন্য কোনো আইনগত কার্যধারা অন্য কোনো আদালত গ্রহণ করতে বা বিচার করতে পারবে না।

এই আইনের বিধি লংঘন করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে জানিয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে, এজন্য সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে।

এই আইনের আওতায় কোনো ব্যক্তি, কোম্পানি বা কারপোরেট প্রতিষ্ঠান দোষী সাব্যস্ত হলে উক্ত ব্যক্তি, কোম্পানি বা করপোরেটের প্রত্যেক পরিচালক, ব্যবস্থাপক, সচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তাও এই অভিযোগে অভিযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে একই শাস্তি পাবেন।

পরিদর্শন কমিটি লিখিতভাবে অভিযোগ দায়ের না করলে এই আইনের আওতায় সংঘটিত অপরাধ কোনো আদালতে বিচারের জন্য আনা যাবে না।

এই আইন লংঘনকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়াসহ যে কোনো পর্যায়ে সরকার প্রদত্ত যে কোনো সুযোগ-সুবিধা বন্ধ বা স্থগিত রাখা যাবে।

“এই আইন বা এর কোনো বিধির অধীনে সরল বিশ্বাসে সম্পাদিত বা সম্পাদনের লক্ষ্যে অভীষ্ট কোনো কাজের জন্য কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা রুজু বা অন্য কোনো আইনত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না।”

সরকার গেজেট প্রণয়নের মাধ্যমে এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণে বিধি প্রণয়ন করতে পারবে।

প্রেক্ষাপট

অবাধ তথ্য প্রবাহ ও সংবাদপত্র শিল্পের সুষ্ঠু বিকালের জন্য ‘দ্য নিউজপেপার ইমপ্লয়েস (চাকরির শর্তাবলী) আইন- ১৯৭৪’ প্রবর্তন করে সরকার। ওই আইনে সাংবাদিক, প্রেস শ্রমিক ও প্রেস কর্মচারীদের চাকরির শর্ত, আর্থিক বিষয় ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করা ছিল।

সরকার এই আইনকে রহিত করে সব শ্রমিকের জন্য ২০০৬ সালে ‘শ্রম আইন’ প্রণয়ন করে, যাতে শুধু সংবাদপত্রের সাংবাদিক, প্রেস শ্রমিক ও প্রেস কর্মচারীদের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এই প্রেক্ষিতে ১৯৭৪ সালের আইনের মূল চেতনাকে অক্ষুণ্ন রেখে গণমাধ্যম কর্মী (চাকুরির শর্তাবলী) আইন- ২০১৭ নামে নতুন আইন করা হচ্ছে।