রোহিঙ্গা প্রশ্নে রাশিয়া-চীন পাশে আছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব ধরনের কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, এ সমস্যার সমাধানে রাশিয়া ও চীনকেও বাংলাদেশের পাশে পাচ্ছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Oct 2017, 11:29 AM
Updated : 18 Oct 2017, 11:43 AM

মিয়ানমারের রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে গত ১৩ অক্টোবর নিরাপত্তা পরিষদের ‘আরিয়া ফর্মুলা’ বৈঠক সম্পর্কে সাংবাদিকদের জানাতে বুধবার ঢাকায় এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, রাশিয়ার প্রতিনিধি সেখানে কফি ‘আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন’ করার কথা বলেছেন। আর চীনের প্রতিনিধি ‘সমস্যার মূলে যাওয়ার’ কথা বলেছেন।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অধিকাংশ দেশ ও সংস্থা রোহিঙ্গা নিপীড়নের ঘটনায় সমালোচনায় মুখর হলেও মিয়ানমারের মিত্র চীন ও রাশিয়া এর আগে সেনা অভিযানের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে। এর সূত্র ধরে বিএনপি বলে আসছে, রোহিঙ্গা প্রশ্নে কূটনৈতিক তৎপরতায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে সরকার।      

এর জবাব দিতে গিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের ‘আরিয়া ফর্মুলা’সভার কথা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “কূটনৈতিক উদ্যোগ হল চলমান প্রক্রিয়া। এখন রাশিয়া কফি আনানের রিপোর্ট সাপোর্ট করেছে। বাংলাদেশ তো কফি আনান কমিশনের রিপোর্টের বাস্তবায়ন চায়। তাহলে রাশিয়া কীভাবে মিয়ানমারের পক্ষে ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গেল- এটা আমি বুঝতে পারলাম না।”

চীনের প্রতিনিধির বক্তব্য প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “চীনের রিপোর্টে কফি আনানের রিপোর্টের বিষয়ে বক্তব্য নেই। কিন্তু চীনের ভাষাটা অন্যরকম। তারা রাখাইন সম্পর্কে ‘হিস্টোরিক্যাল ও ইউনিক ব্যাকগ্রাউন্ড’ শব্দগুলো ব্যবহার করেছে।

“তার মানে হল, এই লোকগুলো (রোহিঙ্গা) পরশুদিন ওখানে যায়নি, যুগ যুগ ধরে তারা সেখানে বসবাস করছে। গতকালের ঘটনাকে তো হিস্টোরিক্যাল বলে না। তারা (চীন) নির্যাতন বন্ধ করতে বলেছে। তারা রাখাইন সমস্যাকে আলাদা করছে, আমরাও আলাদা করছি। কোথায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গেল?”

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যে পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন, তার বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তোলার ওপর জোর দেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তিনি বলেন, এটা বাংলাদেশে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য’।

“জাতিসংঘ মহাসচিব ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা জরুরি। এ বিষয়ে বাংলাদেশের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।”

সেই প্রচেষ্টার ফলও যে দৃশ্যমান, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মাহমুদ আলী বলেন, জাতিসংঘ সংস্থা ওসিএইচএ, ইউনিসেফ, আইওএমের প্রধানরা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি দেখে গেছেন এবং বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা বলে গেছেন।

রোহিঙ্গাদের সহায়তার আর্থিক তহবিল সংগ্রহের জন্য আগামী ২৩ অক্টোবর জেনেভায় একটি সম্মেলন হবে, সেখানে বাংলাদেশকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের তিনটি প্রতিনিধিদল কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে মিয়ানমারে নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে।

মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত ৫ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ না হওয়ার কারণেই এভাবে অনুপ্রবেশ চলছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নিরাপদে তাদের দেশে ফেরত পাঠানোই আমাদের মূল লক্ষ্য।”

তিনি বলেন, “জাতিসংঘের মহাসচিবের লিখিত অনুরোধে নিরাপত্তা পরিষদ ইতোমধ্যে কয়েক দফা রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করেছে। ১৩ অক্টোবর নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে।”

১৯৮৯ সালের পর এবারই প্রথম জাতিসংঘ মহাসচিব নিরাপত্তা পরিষদকে এ ধরনের একটি বিষয়ে চিঠি দিলেন এবং গত নয় বছরে এইবারই প্রথাম নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে মিয়ানমার বিষয়ে বিবৃতি দিল বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান।

গত ১৩ অক্টোবর নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা বিষয়ে ‘আরিয়া-ফরমুলা’ সভায় রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশনের চেয়ারম্যান জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানও বক্তব্য দেন।

সমসাময়িক সঙ্কট বা সমস্যা নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের অনানুষ্ঠানিক গোপনীয় সভা ‘আরিয়া ফর্মুলায়’ পরিষদের সদস্য রাষ্ট্র ছাড়াও সংশ্লিষ্ট অন্য রাষ্ট্র, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে আয়োজিত এবারের আরিয়া ফর্মূলা সভায় নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ দেশ এবং অস্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র বলিভিয়া, মিশর, ইথিওপিয়া, ইতালি, জাপান, কাজাখস্তান, সেনেগাল, সুইডেন, ইউক্রেন ও উরুগুয়ে ছাড়াও আমন্ত্রিত হিসেবে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইইউ, ওআইসি, ইউএনএইচসিআর ও জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক সংস্থা ওসিএইচএ অংশ নেয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাখাইনে সহিংসতা এখনও বন্ধ হয়নি বলে বৈঠকে তুলে ধরেন ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি। তার বক্তব্যে রাখাইন রাজ্যের ‘প্রকৃত চিত্র’ অনেকটাই উঠে আসে।

“বিশেষত সহিংসতা বন্ধের কোনো লক্ষ্যণই দেখা যাচ্ছে না এবং (বাংলাদেশে) অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেই চলেছে বলে তারা উল্লেখ করেছেন। রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত নির্মম নির্যাতনের কথাও তাদের বক্তব্যে এসেছে।”

মাহমুদ আলী জানান, সহিংসতা বন্ধ ও বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে সেকথা কফি আনান তার বক্তব্যে তুলে ধরেন।

“তার নেতৃত্বাধীন কমিশনের প্রতিবেদন গ্রহণ করায় এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানানোয় মিয়ানমারকে তিনি ধন্যবাদ দেন। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে তার কমিশনের সুপারিশ সমূহ বাস্তবায়নে বিশেষত বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানান।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী জানান, ‘আরিয়া ফর্মূলা সভা’ শেষে দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নিরাপত্তা পরিষদের চলতি মাসের সভাপতি ফ্রান্সও রাখাইনের সহিংসতার ঘটনাকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ আখ্যায়িত করেছে।