যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে অবস্থানরত সাংস্কৃতিক সংগঠক এই মুক্তিযোদ্ধা বলেছেন, খান আতাউর রহমান একজন সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন। কিন্তু একাত্তরে তিনি ‘পাকিস্তানের সমর্থক’ ছিলেন; দেশ ও মানুষের পাশে দাঁড়াতে ‘ব্যর্থ হয়েছিলেন’।
“ব্যক্তিগতভাবে তার বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নাই। শিল্পী হিসাবে তার প্রশংসা করি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালে তার ভূমিকার সমালোচনা তো করতেই পারি।”
গত ১২ অক্টোবর নিউ ইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশিদের এক অনুষ্ঠানে প্রশ্নোত্তর পর্বে বাচ্চু বলেন, “খান আতা অনেক বড় শিল্পী এটা অস্বীকার করব না, কিন্তু খান আতা রাজাকার। আমি না হলে খান আতা বাঁচত না। আমি গৌরব করব না, আমি না হলে খান আতা সেভেনটি ওয়ানে মারা যায়, ষোলই ডিসেম্বরের পরে।”
১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া খান আতা পরিচালিত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সিনেমা ‘আবার তোরা মানুষ হ’ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট যেভাবে উপস্থাপন করেছে, তা নিয়েও সমালোচনা করেন একাত্তরের রণাঙ্গনের যোদ্ধা বাচ্চু।
তিনি বলেন, “আবার তোরা মানুষ হ- খুবই নেগেটিভ ছবি। মুক্তিযোদ্ধাদের বলতেছে আবার তোরা মানুষ হ। আরে তুই মানুষ হ… তাই না… তুই তো রাজাকার ছিলি।”
ওই অনুষ্ঠান আর বাচ্চুর বক্তব্যের ভিডিও ফেইসবুকে তুমুল আলোচনার জন্ম দেয়।
খান আতাকে নিয়ে ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তার ছেলে সংগীতশিল্পী আগুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খান আতাউর রহমান জনতার মানুষ। তার সম্পর্কে কিছু বললে আগে জনতা উত্তর দিবে, তার উপর ভিত্তি করে আমি প্রেসকনফারেন্স ডাকব। বাচ্চু চাচা এতবড় একজন মানুষ, প্রিয় একজন মানুষ, নিশ্চয়ই কোনো একটা গণ্ডগোল আছে।… জনগণ উত্তর দিবে, আর আমার কাছেও এর উত্তর আছে।”
এই আলোচনার মধ্যে রোববার নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যাসহ ওই বিবৃতি দেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু।
“বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংগীত পরিচালক খান আতাউর রহমান ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অপারগ হয়েছিলেন। যে ৫৫ জন বুদ্ধিজিবী ও শিল্পী ১৯৭১ -এর ১৭ মে মুক্তিযুদ্ধকে ‘আওয়ামী লীগের চরমপন্থিদের কাজ’ বলে নিন্দাসূচক বিবৃতি দিয়েছিলেন, দুঃখজনকভাবে খান আতাউর রহমান তার ৯ নম্বর স্বাক্ষরদাতা ছিলেন। ১৭ মে ১৯৭১ দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা দ্রষ্টব্য।”
বাচ্চু বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার চালাতে যারা বাধা দিয়েছিল, যারা পাকিস্তানপন্থি প্রচারে সহযোগিতা করেছিল, তাদের শনাক্ত করতে বাংলাদেশ সরকার শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক নীলিমা ইব্রাহীমকে প্রধান করে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করেছিল।
“১৯৭২ এর ১৩ মে নীলিমা ইব্রাহীম কমিটি যে তালিকা সরকারকে পেশ করেন, সে তালিকায় ৩৫ নম্বর নামটি খান আতাউর রহমানের।”
মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে স্বাধীন বাংলাদেশে মঞ্চ নাটককে আন্দোলনের রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে সামনের কাতারে ছিলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। আর খান আতা তখন ঢাকাই চলচ্চিত্রের একজন জনপ্রিয় পরিচালক, সুরকার, গীতিকার।
বাচ্চু বলেন, খান আতা যে একজন গুণী শিল্পী, তা ‘অনস্বীকার্য’। তার সৃষ্টিশীলতা নিয়েও ‘কোনো প্রশ্ন নেই’। মুক্তিযুদ্ধের আগে তার অনেক সিনেমা মানুষকে উজ্জীবিত করেছে ।
“কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন এবং তা তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। আবার আলতাফ মাহমুদ, জহির রায়হান, শহীদুল্লাহ কায়সারের মত শিল্পী-সাহিত্যিকরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাদের স্বীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এবং শাহাদাত বরণ করেছেন।
“অনেকের মনে প্রশ্ন উদ্রেক হয়েছে যে, ৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর অব্যহতিতে কেন আমি বা আমরা তাকে রক্ষা করেছিলাম। কারণ খান আতাউর রহমান কোনো প্রকার মানবতাবিরোধী কর্মে লিপ্ত ছিলেন না; যদিও পাকিস্তানিদের সমর্থনে রেডিও-টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করেছেন।”
বাচ্চু বলেন, “আমরা এও ভেবেছি, ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, অনেকে পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বন করেছে। আমরা তা বিচারের এখতিয়ার রাখি না।
“তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের এ কথা বাধ্যতামূলক মানতে হয়েছিল যে, কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধোত্তর সময়ে কারো ক্ষতি বা আঘাত করা যাবে না। বিচারিক প্রক্রিয়ায় দোষী সাব্যস্তদের বিচার করা হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে। মুক্তিযোদ্ধারা সেই আদেশ পুরোপুরিভাবে মেনেছিল বিধায় যুদ্ধোত্তরকালে প্রাণহানির ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কম হয়েছিল।”
মুক্তিযোদ্ধারা জেনেভা কনভেনশন পুরোপুরি মানলেও পাকিস্তানিরা জেনেভা কনভেনশনের তোয়াক্কা করেনি বলে মন্তব্য করেন বাচ্চু।
তিনি বলেন, “ইতিহাসের দায় থেকে আমি খান আতাউর রহমান সম্পর্কে উক্তিটি করেছিলাম।… আশা করি আমার এ বক্তব্য সকল তর্ক-বিতর্কের অবসান ঘটাবে।”