সড়ক ভাঙছে কার দোষে

সারাদেশে বেহাল সড়কে যাত্রী ও চালকদের যখন চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর তখন বরাবরের মতই বন্যা আর অতিবৃষ্টির দোহাই দিয়ে দায় সারতে চাইছে।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Oct 2017, 05:23 PM
Updated : 6 Oct 2017, 05:59 PM

তবে বিশেষজ্ঞ ও পরিবহন মালিকরা বলছেন, নকশা ও নির্মাণে ত্রুটি এবং মেরামতে গাফিলতির কারণে বাংলাদেশে সড়ক দ্রুত নষ্ট হয়।

এবছর বন্যা আর অতিবৃষ্টিতে সারাদেশে দুই হাজার ৩০ দশমিক ১৮ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সড়ক মেরামতে জরুরি ভিত্তিতে ১৯৩ কোটি ৪৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ চেয়ে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদ্প্তর।

বর্ষা শেষে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মহাসড়কের চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করবে সওজ। সে সময় ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার টঙ্গী-ঘোড়াশাল-পাঁচদোনা সড়ক ঘুরে দেখা গেছে অসংখ্য খানাখন্দ। ঢাকা, সাভার,গাজীপুর এবং উত্তরবঙ্গ থেকে সিলেটসহ দেশের পূর্বাঞ্চলে যাওয়ার এই সড়কের বেশিরভাগ জায়গা ভেঙে গেছে।

যানবাহন চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্ষার শুরু থেকে সড়কে ভাঙন শুরু হয়েছে। এখন সামান্য বৃষ্টি হলেও সড়কটি যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

মহাখালী-ভৈরব রুটের উত্তরা পরিবহনের চালক বিল্লাল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে তারা এই সড়কে গাড়ি নিয়ে আসছেন না।

“পুরা রাস্তাই খারাপ। বেশি খারাপ পূবাইলের আগে-পরে। সেইজন্য গাড়ি মিরেরবাজার থাইকা ঢাকা বাইপাস সড়ক দিয়া কাঞ্চন, গাউসিয়া হইয়া সিলেট রোডে উঠি। সেইদিক দিয়া যাই।”

এ কারণে পরিবহন ব্যবসায়ীরাও বিপাকে পড়েছেন বলে জানান বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সোহেল তালুকদার।

তিনি বলেন, “রাতে চট্টগ্রাম থেকে রওনা হয়ে যদি পরদিন দুপুর আড়াইটা তিনটায় ঢাকা পৌঁছাতে হয় তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? আমাদের গাড়ি ভোর ৫টায় ঢাকা পৌঁছে আবার ট্রিপ নিয়ে দুপুর ২টার মধ্যে চিটাগাং চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু দুপুর ২টার মধ্যে ঢাকাতেই পৌঁছাতে পারছে না। বেশিরভাগ সড়কেরই এ অবস্থা।”

সড়কগুলো ভাঙছে কেন?

এ প্রশ্নে সওজ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিবছরই বন্যায় সড়ক ভাঙে। অতিবৃষ্টির কারণে বিটুমিন আলগা হয়ে সড়কের বিভিন্ন অংশে ভাঙন দেখা দেয়।

আবার সড়ক মেরামতের জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ না থাকায় সময়মতো মেরামত করা যায় না। ফলে রাস্তাগুলো আবার ভেঙে যায় বলে সওজের একাধিক প্রকৌশলীর ভাষ্য।

ঢাকার পাশের এক জেলায় এ সংস্থার নির্বাহী প্রকৌশলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সড়ক মেরামতের জন্য সওজ প্রতিবছর যে চাহিদাপত্র দেয়, সে অনুযায়ী বরাদ্দ পাওয়া যায় না।

“সারাদেশের একই অবস্থা। যে বরাদ্দ আসে, তাতে আমার জেলার ক্ষতিগ্রস্ত সব সড়ক মেরামত করা যায় না। যে টাকা দেয় তা দিয়েই কাজ চালাতে হয়। ফলে মেরামতের পর সড়কের স্থায়ীত্ব যা হওয়ার কথা তা হয় না।”

# সওজের অধীনে থাকা সড়কের অবস্থা জরিপের দায়িত্বে আছে মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ- এইচডিএম।

# তাদের ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোট সড়কের ৩৭ শতাংশ ‘খারাপ ও খুব খারাপ’ পর্যায়ে ছিল। প্রায় ২৪ শতাংশ ছিল ‘চলনসই’। ৩৯ শতাংশ সড়ক সওজের হিসাবে ছিল ‘ভালো’ অবস্থায়।

# এর মধ্যে তিন হাজার ৭৯০ কিলোমিটার মহাসড়কের ৫৪ শতাংশ ভালো, প্রায় ২৬ শতাংশ সড়ক চলনসই এবং বাকি ২০ শতাংশ মহাসড়ক খারাপ ও খুব খারাপ পর্যায়ে ছিল।

# সওজের অধীন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়ক আছে ২১ হাজার ১২৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার।

# এইচডিএম এ বছরের প্রতিবেদন এখনও প্রকাশ করেনি। তবে বন্যার কারণে চলতি বছরের ক্ষতির চিত্র গতবারের চেয়ে খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক বলে কর্মকর্তারা মনে করছেন।  

সওজের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান বলছেন, অতিরিক্ত মালবোঝাই যানবাহনের কারণে সড়কের ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি।

তার ভাষায়, তিনগুণ অতিরিক্ত মাল বহনকারী একটি যান আসলে সড়কের ৮১ গুণ ক্ষতি করে।

“ক্ষতির পরিমাণ জানার একটা অংক আছে। ক্ষতি হবে বাড়তি ওজনের চার গুণিতক। ধরুন, আট টন এক্সেল লোডের একটি গাড়ি বেশি ওজন নিচ্ছে। ওজন দ্বিগুণ হলে ক্ষতি হবে টু টু দি পাওয়ার ফোর, তিনগুণ হলে হবে থ্রি টু দি পাওয়ার ফোর। অর্থাৎ, রাস্তায় যদি তিনগুণ অতিরিক্ত ওজনের গাড়ি চলে তাহলে প্রকৃতপক্ষে ক্ষতি হয় ৮১ গুণ।”

ইবনে আলম হাসান বলেন, ৮১ গুণ ক্ষতি ঠেকাতে হলে রাস্তা হতে হবে ৮১ গুণ শক্তিশালী। মানে খরচও ৮১ গুণ বাড়বে।

“এটা অসম্ভব, এটা পৃথিবীর কোথাও হয় না। সড়ক ডিজাইনের নীতির সঙ্গেও যায় না।”

‘এক্সেল লোড’ নিয়ন্ত্রণে রেখে এখনকার মানে নির্মাণ করেই তা ঠিক রাখা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন সওজের প্রধান প্রকৌশলী।

“অনেকের ভুল ধারণা, অতিরিক্ত ওজনের যানবাহন চলাচলের উপযোগী করে সড়ক তৈরি করলে সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু পৃথিবীর কোথাও অতিরিক্ত ওজনের জন্য রাস্তা নির্মাণ করা হয় না। বরং ওজনটা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।”

রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমাদের একটা টার্গেট থাকে। সেই টার্গেটে কখনও যাওয়া যায়, কখনো যাওয়া যায় না। আমরা যে বাজেট পাই তাকে অপ্রতুল বলব না, তবে তুলনামূলকভাবে কম।”

সওজের যুক্তি মানতে নারাজ বিশেষজ্ঞ ও পরিবহন মালিকরা

বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল ইসলাম বলছেন, নির্মাণত্রুটি, রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি এবং সড়কের নিষ্কাশন ব্যবস্থা ও পাশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণেই সড়ক দ্রুত ভাঙছে।

এর উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, গাজীপুর থেকে মদনপুর পর্যন্ত ঢাকা বাইপাস সড়ক নির্মাণের এক মাসের মধ্যে দেবে গিয়েছিল নকশার ত্রুটির কারণেই।

“কনস্ট্রাকশনেও কিছুটা ত্রুটি আছে। আবার সড়ক নির্মাণের সময় নজরদারিতে আমাদের গাফিলতি আছে। এ কারণে ভালো ম্যাটেরিয়াল, ভালো ডিজাইন- কোনো কিছুই কাজে দেয় না।”

রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতির বিষয়টি তুলে ধরে অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, “সওজ রক্ষণাবেক্ষণ নিজে না করে ঠিকাদারকে দেয়। ঠিকাদার আবার অল্প ভাঙলে মেরামত করে না। আরও বেশি করে ভাঙতে দেয়। বেশি ভাঙলে টেন্ডারের মাধ্যমে তারা মেরামতের কাজটা পায়। অথচ পৃথিবীর সবখানে নিয়মটা অন্যরকম। রাস্তা যদি সামান্য ভাঙার সম্ভাবনাও থাকে, তাহলে কর্তৃপক্ষই তা নিজেরা মেরামত করে ফেলে।”

বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সোহেল তালুকদার বলেন, “রাস্তা ভাঙলে এখানে সবাই বৃষ্টির কথা বলে। অথচ যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডে এমন কোনো দিন নেই যে বৃষ্টি হয় না। কই, ওদের দেশের রাস্তার তো এমন ছালবাকল উঠে যাচ্ছে না। আর সড়কে যে এখন ভারী যানবাহন চলাচল করছে সেটা তো সড়ক বিভাগ জানে।”

তার ধারণা, বাংলাদেশে যেভাবে রাস্তা বানানো হচ্ছে, সেখানে নিশ্চয়ই কোনো ত্রুটি আছে।

“অথবা নকশা ঠিক থাকলেও নকশা অনুযায়ী রাস্তা তৈরি হচ্ছে না। এমনও হয়েছে, বানানোর এক মাসও হয়নি, সেই রাস্তার ছালবাকলা সব উঠে গেছে। আসলে আমাদের মূল জায়গাটায় ফোকাস করা হচ্ছে না।”