দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার উপস্থিতিতে সচিব শাহ কামাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনেএ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, “পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের নাগরিকদের ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক’ বলতে হবে।”
এর আগে ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হাই কমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডির সঙ্গে সরকারের এক বৈঠকের পর ত্রাণ সচিব জানিয়েছিলেন মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও এখনই তাদের ‘শরণার্থী’ মর্যাদা দিচ্ছে না বাংলাদেশ।
শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে কোনো দেশকে উদ্বাস্তুদের বেশ কিছু অধিকার দিতে হয়। সরকারিভাবে রোহিঙ্গাদের এতদিন ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলা হচ্ছিল।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী নতুন করে দমন অভিযান শুরুর পর ২৫ অগাস্ট থেকে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে এবং ত্রাণ ব্যবস্থাপনার জন্য তাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের কাজ চলছে; ইতোমধ্যে ৬১ হাজার রোহিঙ্গা নিবন্ধনও কার্ড পেয়েছেন।
গত ১১ সেপ্টেম্বর এই নিবন্ধন শুরুর সময় ওই পরিচয়পত্রে তাদের মিয়ানমারের রোহিঙ্গা লেখা হচ্ছিল। পরে লেখা হচ্ছিল মিয়ানমারের মুসলিম। শেষ পর্যন্ত সরকারের সিদ্ধান্তে তাদের লেখা হচ্ছিল ‘মিয়ানমার ন্যাশনাল’।
নিবন্ধন কার্যক্রমে অংশ নেওয়া একজন সেনা কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া অনেকেই নিবন্ধন করাতে এসে কার্ডে লেখা জাতীয়তার পরিচিতি নিয়ে আপত্তি করেছেন। তাদের দাবি, পরিচয়পত্রে তাদের ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা’ লিখতে হবে।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা দূর অতীতের আরব বণিকদের বংশধর বলে মনে করা হয়। বহুকাল ধরে তারা মিয়ানমারের আরাকানে (নাম বদলে যা এখন রাখাইন) বসবাস করলেও মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিক হিসেবে মানতে নারাজ।
মিয়ানমার সরকারের দাবি, এরা বাংলাদেশ থেকে আসা ‘অবৈধ অভিবাসী’। সরকারি নথিপত্রে তাদের বর্ণনা করা হয় ‘বাঙালি’ হিসেবে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনার মুখে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি গত মাসে রাখাইনের সঙ্কট নিয়ে পার্লামেন্টে ভাষণ দেন। রাখাইনের পরিস্থিতির কারণে মুসলমানদের পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার কথা স্বীকার করলেও আধা ঘণ্টার ওই বক্তৃতায় কোথাও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি তিনি।
গতবছরের সহিংসতা নিয়ে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, সু চি সরকারের অনুরোধে সেখানে রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে না। তবে সরকারের ভাষায় বাঙালিও বলা হচ্ছে না। প্রতিবেদনে ওই জনগোষ্ঠীকে বর্ণনা করা হয় রাখাইনের মুসলমান হিসেবে।
বিবিসির সাংবাদিক জোনাহ ফিশার সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সংঘাত এড়ানোর চেষ্টায় জাতিসংঘের মিয়ানমার কার্যালয়ের অনেক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি না লিখে ‘রাখাইনের মুসলমান’ শব্দটি ব্যবহার করা হত।
এমনকি গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক বিবৃতিতেও রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার না করতে দেখা গেছে।
এবার সঙ্কট ঘনীভূত হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের অধিকারের প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান আগের চেয়ে অনেক স্পষ্ট করা হয়েছে। জাতিসংঘের মত বাংলাদেশও রাখাইনের দমন-পীড়নকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে দেখছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা সঙ্কটের মূল কারণগুলো তুলে ধরে এর নিরসনে পাঁচ দফা প্রস্তাব দেন।
মিয়ানমারে ‘জাতিগত নিধন’ বন্ধ করে সেখানে জাতিসংঘ মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল পাঠানো, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে নিরাপত্তা দিতে মিয়ানমারের ভেতরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলা, রাখাইন থেকে বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের বাড়িঘরে ফিরিয়ে নেওয়া এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশের পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার কথা বলা হয় এসব প্রস্তাবে।