কুতুপালং ক্যাম্পে থাকবে সব রোহিঙ্গা: ত্রাণমন্ত্রী

দমন-পীড়নের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কুতুপালং ক্যাম্পে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার; ক্রমান্বয়ে বন্ধ করে দেওয়া হবে অন্যান্য ক্যাম্প।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Oct 2017, 06:55 AM
Updated : 6 Oct 2017, 05:44 PM

গত ২৫ অগাস্ট থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, এর মধ্যে ৬১ হাজার রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া।

বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “কুতুপালং ক্যাম্পের বাইরে যেসব ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা থাকছেন ক্রমান্বয়ে তা গুটিয়ে একই ক্যাম্পে সবাইকে রাখা হবে। সবাইকে কুতুপালং ক্যাম্পে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।”

ক্যাম্পের বাইরে পাহাড়ি এলাকা ও অন্যান্য স্থানে যেসব রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে, তাদের ফিরিয়ে আনার কাজ শুরুও হয়েছে। ৩ অক্টোবর বান্দরবানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিব শাহ কামাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের নাগরিকদের ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক’ বলতে হবে।”

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী নতুন করে দমন অভিযান শুরু করলে ২৫ অগাস্টের পর থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয়। এর বাইরে আরও প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা গত কযেক দশক ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে।

মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিজেদের নাগরিকের স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। সেনাবাহিনীর অভিযানকে তারা ‘সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই’ হিসেবে দেখাতে চাইছে, যদিও জাতিসংঘ একে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গত ২ অক্টোবর ঢাকায় এসে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বৈঠক করেন। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের সিদ্ধান্ত হয় সেখানে।

এদিকে রোহিঙ্গারা দেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করায় তাদের এক জায়গায় রাখা ও নিবন্ধনের  পাশাপাশি বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হচ্ছে সরকারকে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাংসদ আসিকুল্লাহ রফিক,  দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মো. শাহ কামাল, কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম, মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন দপ্তর প্রধান এবং সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি ও আনসারের প্রতিনিধিরা মঙ্গলবার কক্সবাজার সার্কিট হাউজে এক সমন্বয় সভা করেন। সেখানেই সব রোহিঙ্গাকে কুতুপালং ক্যাম্পে রাখা এবং ক্যাম্প ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত হয়।

সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে ত্রাণমন্ত্রী বলেন, “ক্যাম্পের ভেতরের নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা, খাদ্য সরবারহ, স্যানিটেশন, রেজিস্ট্রেশন, চিকিৎসাসহ সব কাজ সুচারুভাবে করার স্বার্থে সবাইকে একটি ক্যাম্পে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”

 

>>  সীমান্তবর্তী কুতুপালং ক্যাম্পের পাশে তিন হাজার একর এলাকা নিয়ে ক্যাম্প করে সাময়িকভাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

>> ক্যাম্পকে ২০টি ব্লকে ভাগ করে প্রতিটি ব্লকের জন্য একটি প্রশাসনিক ও পরিষেবা ইউনিট ও একটি গুদাম স্থাপন করা হচ্ছে, যাতে সব ধরনের সেবা দেওয়া সহজ হয়।

>> পরে ব্লকগুলোকে ক্যাম্পে রূপান্তর করা হবে। ব্লকের কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে প্রত্যেক ব্লকে একজন কর্মকর্তার পদায়ন করা হয়েছে।

>> কুতুপালংয়ে ইতোমধ্যে ৭৫ হাজারের বেশি শেড নির্মাণ করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় শেড বাড়িয়ে দেড় লাখ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

>> প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৪টি গোডাউন নির্মাণের অংশ হিসেবে পাঁচটি গোডাউনের কাজ শেষ হয়েছে। এর বাইরে ২০টি ব্লকে ২০টি গোডাউন হবে।

>> প্রতিদিন গড়ে সাত থেকে আট হাজার রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর এ কাজে সহযোগিতা করছে। আগামী দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে সব রোহিঙ্গার নিবন্ধন শেষ করার আশা করছেন ত্রাণমন্ত্রী।

বিশ্ব খাদ্য সংস্থা পাঁচ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গার খাদ্যের সংস্থান করছে জানিয়ে ত্রাণমন্ত্রী মায়া বলেন, এর বাইরে বাকিদের খাদ্য যোগানো হচ্ছে দেশি-বিদেশি সংস্থা থেকে পাওয়া ত্রাণ থেকে।

বর্তমানে ২০টি পয়েন্ট থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। সরকারিভাবে ক্যাম্পে ৩৬টি কমিউনিটি হাসপাতাল ইউনিট করা হয়েছে। সেখানে প্রায় পাঁচ হাজার গর্ভবতী নারীকে এ পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়েছে।

কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুপালং শরণার্থী শিবির

এছাড়া দুই লাখ রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন ধরনের টিকা দেওয়া হয়েছে এবং ৬১ হাজারকে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল দেওয়া হয়েছে।

১২ লাখ রোহিঙ্গাকে কলেরা ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রস্তুতিও শেষ করা হয়েছে বলে জানান ত্রাণমন্ত্রী।

তিনি বলেন, শরণার্থীদের জন্য সাড়ে তিন হাজার টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে, আরও সাড়ে ১৭ হাজার টয়লেট স্থাপনের কাজ চলছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এক হাজার ৯০০টি স্যানিটারি টয়লেট ও এক হাজার ৫২৮টি টিউবওয়েল স্থাপন করেছে। ১৪টি মোবাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ও সাতটি ওয়াটার ট্রাকের মাধ্যমে খাবারের পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।

বর্ধিত ক্যাম্প এলাকা আলোকিত করতে নয় কিলোমিটার নতুন বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। ক্যাম্পে পরিবেশবান্ধব চুলা সরবরাহ করা হচ্ছে।

ক্যাম্প এলাকায় সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ১৮ কিলোমিটার ও এলজিইডি মাধ্যমে নয় কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ক্যাম্পের ভেতর নতুন পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন এবং পর্যাপ্ত আনসার মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেখানে ফায়ার সার্ভিসের নতুন একটি ইউনিট স্থাপন করা হবে বলেও জানান ত্রাণমন্ত্রী।

রোহিঙ্গাদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন উদ্যোগের কথা সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরে মায়া বলেন, “অতি দ্রুত মিয়ানমান তার নাগরিকদের ফেরত নেবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।”