রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে হবে ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’

দমন অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Oct 2017, 05:56 AM
Updated : 2 Oct 2017, 08:58 AM

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে ঢাকা সফররত মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের বৈঠকে সোমবার এই সিদ্ধান্ত হয়।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দেড় ঘণ্টার এই বৈঠকে মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ে। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ও পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক।

বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে’ আলোচনা হয়েছে এবং সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছে মিয়ানমার।

এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সার্বিক তত্ত্বাবধানে দুই দেশ একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা উভয়ে সম্মত হয়েছি।এই জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের কম্পোজিশন কী হবে- সেটা আমরা বাংলাদেশও ঠিক করব, ওরাও ঠিক করবে। সম্মতিটা হয়েছে এই আলোচনায়।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জন্য বৈঠকে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলকে ওই চুক্তির খসড়াও হস্তান্তর করা হয়েছে।

বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে ‘নিরাপত্তা সহযোগিতার’ বিষয়েও ‘অত্যন্ত ফলপ্রসূ’ আলোচনা হয়েছে এবং বাংলাদেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ পুনর্ব্যক্ত করেছে বলে মাহমুদ আলী জানান।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে আরও আলোচনার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল শিগগিরই মিয়ানমার সফরে যাবেন।

“আমরা যেটা বলে আসছি প্রথম থেকে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে আমরা এই সমস্যার সমাধান করতে চাই। দুই পক্ষই তাতে একমত হয়েছে,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া কবে শুরু হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “একটা সভা দিয়েতো সব সমাধান হবে না। জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপটা তৈরি করতে হবে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে দেব, ওরা ওদের পক্ষ থেকে দেবে। এটা খুব তাড়াতাড়ি করেছি।”
 
যে বিষয়গুলো বাকি রয়েছে, আলোচনার মাধ্যমে সেগুলোর সমাধান করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
 
জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ কবে নাগাদ গঠন হবে জানতে চাইলে তিনি শুধু বলেন, “খুব শিগগিরই হবে।”

মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের মুখে গত ২৫ অগাস্ট থেকে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

তারা বলছেন, সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ মারছে। রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম।

মিয়ানমারের নেত্রী সু চি সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে ‘সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই’ হিসেবে বর্ণনা করলেও জাতিসংঘ একে চিহ্নিত করেছে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে।

রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি দেখতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে সেখানে যেতে দিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। এমনকি সেখানে আইসিআরসি ছাড়া অন্য কোনো সংস্থাকে ত্রাণ দিতেও বাধা দেওয়া হচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় তিনি বলেন, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের উপর যে সহিংসতা হয়েছে তা মধ্যাঞ্চলেও বিস্তৃত হতে পারে এবং সেখানে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

পাঁচ দশকের বেশি সময় সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারে গত বছর সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সু চির দল ক্ষমতায় এলেও এখনও দেশটির স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক মন্ত্রণালয় দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে।

সম্প্রতি মিয়ানমার ঘুরে আসা ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, অং সান সু চি সব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতে চান বলে তাকে আশ্বস্ত করেছেন।

“সু চি একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আছেন এবং তিনি আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপের মধ্যে একটি সঠিক পথ বের করার চেষ্টা করছেন।”

এদিকে মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী উ উইন মিত আয়ে রাখাইনের মংডু এলাকায় ‘যত দ্রুত সম্ভব’ রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন ও পুনর্বাসন শুরু করার ঘোষণা দিয়েছেন বলে গত বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে জানায় নির্বাসিত বার্মিজদের ওয়েবসাইট ইরাবতী।

সেখানে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন ও পুনর্বাসনের জন্য দুই বিলিয়ন কিয়াটের একটি কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, যাতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যকার ১৯৯৩ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় শরণার্থীদের নিবন্ধন করা হবে। মংডুর দার গি জার গ্রামে পুনর্বাসনের আগে তাংপিও লেতওয়ে ও না খুয়ে ইয়া গ্রামে তাদের নিবন্ধন হবে।

মিয়ানমারের শ্রম, অভিবাসন ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের পার্মানেন্ট সেক্রেটারি উ মিন্ট কেইং ওই দিন ইরাবতীকে বলেন, দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য যাদের মনোনীত করা হবে তাদের ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) দেওয়া হবে।

‘রোহিঙ্গা’ স্বীকৃতি না থাকায় এই মুসলিম জনগোষ্ঠী ওই এনভিসি নিতে আপত্তি জানিয়ে আসছিল বলে ইরাবতীর প্রতিবেদনে বলা হয়।