স্পষ্ট জানিয়েছি, রোহিঙ্গাদের ফেরাতে হবে: প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ প্রয়োজনে এক বেলা খেয়েও নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবে, কিন্তু এই শরণার্থীদের যে ফিরিয়ে নিতে হবে, সে কথা মিয়ানমারকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

রিয়াজুল বাশার নিউ ইয়র্ক থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Sept 2017, 08:02 AM
Updated : 20 Sept 2017, 10:45 AM

মঙ্গলবার রাতে নিউ ইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় তিনি বলেন, “মিয়ানমারকে আমরা বলেছি, আপনাদের নাগরিক, তাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাদেরকে নিরাপদ রাখতে হবে। তাদের আশ্রয় দিতে হবে। তাদের ওপর জুলুম অত্যাচার চলবে না।”

বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ২৪ অগাস্ট রাতে আড়াই ডজন পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে হামলার পর দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের গ্রামে গ্রামে নতুন করে দমন অভিযানে নামে; সীমান্তে শুরু হয় রোহিঙ্গাদের ঢল।

কয়েক যুগ ধরে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গার ভার বহন করে আসা বাংলাদেশের এই দফায় আরও প্রায় চার লাখের বেশি শরণার্থী প্রবেশ করেছে। রাখাইনের পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এই সংখ্যা ১০ লাখে ঠেকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে তার ভাষণে রোহিঙ্গা সঙ্কটের মূল কারণগুলো তুলে ধরে তা নিরসনে বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরবেন বলে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে।

জাতিসংঘ অধিবেশন উপলক্ষে নিউ ইয়র্কে অবস্থানরত শেখ হাসিনা গত দুদিন ধরে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনায় মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছেন।       

ম্যানহাটনের ম্যারিয়ট হোটেলে প্রবাসীদের বাংলাদেশিদের আয়োজনে জনাকীর্ণ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “তাদের (মিয়ানমার) ওপর যেন চাপ সৃষ্টি হয়। তাদের নাগরিক তারা ফেরত নিয়ে যাবে। কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে। সেটাই আমরা চাই।”

মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি মঙ্গলবার বলেছেন, নব্বইয়ের দশকে করা প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় ‘যাচাইয়ের মাধ্যমে’ বাংলাদেশে থাকা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে তার দেশ প্রস্তুত। কিন্তু এই শরণার্থীদের ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে স্বীকার করে না নেওয়ায় এবং তাদের ওপর সেনাবাহিনীর নির্যাতনের বিষয়টি ভাষণে এড়িয়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি সমালোচিত হচ্ছেন।  

শেখ হাসিনা বলেন, “আজকে দুর্ভাগ্য যে, মিয়ানমারে যে ঘটনা ঘটেছে, হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, মেয়েদেরকে ধর্ষণ করা…  এমন পরিবেশ-পরিস্থিতি যেখানে সৃষ্টি হয়েছে, সেখান থেকে দলে দলে মানুষ এসেছে…  আমরা কী করব? মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিতে হয়েছে।”

কক্সবাজারে গিয়ে নিজের চোখে রোহিঙ্গাদের এই দুর্দশা দেখে আসার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি সেখানে গিয়েছিলাম। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার কেবল নিজেদের কথা মনে হয়েছে। আমরাও তো একদিন এইভাবে ওই হানাদার পাকিস্তানিদের কারণে এ ঘর থেকে ওঘরে… আমাদের আশ্রয় খুঁজে বেড়াতে হয়েছে। আমাদের ঘড়বাড়ি সব জ্বালিয়ে ছারখার করেছে। সমগ্র বাংলাদেশে আমাদের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ, তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে। মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে।

“আমাদের দেশের মানুষও তো আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ছিল। আজকে যখন তারা বিপদে পড়েছে, অবশ্যই তাদের জায়গা দিতে হবে।”

শেখ হাসিনা বলেন, “অনেকেই প্রশ্ন করেছে, এত মানুষের খাবার দেবেন কীভাবে? আমি তাদের একটা কথাই বলেছি; ১৬ কোটি মানুষ আমাদের। এই ১৬ কোটি মানুষকে যদি খাবার দিতে পারি তাহলে এই সাত-আট লাখকে খাবার দিতে পারব না?”

বাংলাদেশের মানুষকে ‘অনেক উদার’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রয়োজনে তারা একবেলা খাবে। অন্যবেলার খাবার এই আশ্রিত মানুষকে তুলে দেবে সেই মানসিকতা তাদের আছে। আমরা সেখানে লঙ্গরখানা খুলে দিয়েছি, চিকিৎসা, থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।”

“কিন্তু মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতেই হবে,” জোরের সঙ্গে বলেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, কোনো দেশে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটুক, তা বাংলাদেশ চায় না। বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে প্রতিবেশী কোনো দেশে কাউকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে দেওয়া হবে না- সরকার তা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে।

“আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই। দেশের মানুষের কল্যাণ চাই। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন আমরা করতে চাই। কাজেই সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে যোগাযোগ সমুন্নত রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা… আমরা সেই ব্যবস্থা নিতে চাই।”

রোহিঙ্গা বিষয়ে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ধন্যবাদ জানাতে চাই। আজকে জাতিসংঘে যাদের সঙ্গেই দেখা হচ্ছে, প্রত্যেকেই কিন্তু এ ব্যাপারে যথেষ্ঠ সচেতন।

“মঙ্গলবারই জাতিসংঘে ওআইসির এক বৈঠকে আমি প্রশ্ন রেখেছি, আজকে মুসলমানরা কেন রিফিউজি হয়ে ঘুরে বেড়ায়? আপনারা সকলে কেন এক হন না? কেন সকলে ঐক্যবদ্ধ হন না?”

যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।

শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে দেশের বিভিন্ন খাতের আগ্রগতির কথা তুলে ধরেন এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন।

“আমরা দেশের উন্নতি চাই। আর তারা মানুষকে পুড়িয়ে মারে। ধ্বংসাত্মক কাজ ছাড়া তারা আর কিছুই করতে পারে না।”

দলীয় নেতাকর্মীদের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের তাগিদ দিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “আমি আমার এমপিদেরও বলেছি, আপনারা দেখেন, শেখেন। কীভাবে ভোটারের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করা যায়। ওই বড় বড় গাড়ি-বাড়ি হলেই ভোটাররা ভোট দেবে না। ভোটারের সমস্যা জানতে হবে। সেগুলোর সমাধান করতে হবে। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদেরকে আপনজন ভাবতে হবে।… আগামীতে নির্বাচন। এই ইলেকশনটা বিরাট চ্যালেঞ্জ, এটা মনে রাখতে হবে।”