সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত: স্পিকার

বিচারক অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতিতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Sept 2017, 07:35 PM
Updated : 14 Sept 2017, 07:35 PM

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, সংসদকে ‘অকার্যকর’ বলা জনগণকে অপমানের শামিল।

বৃহস্পতিবার সংসদের সপ্তদশ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে স্পিকার একথা বলেন।

শিরীন শারমিন তার বক্তব্যে ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাস তুলে ধরেন। লিখিত বক্তব্যের অধিকাংশ ইংরেজিতে পড়েন স্পিকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ এসময় সংসদ কক্ষে উপস্থিত ছিলেন।

বক্তব্যের ফাঁকে সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে তাকে সমর্থন জানান। এসময় প্রধানমন্ত্রীও হাসতে হাসতে টেবিল চাপড়ান।

স্পিকার বলেন, “রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গ সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত পরিধি লঙ্ঘন করতে পারে না। তিনটি অঙ্গের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের কোনো একটি অঙ্গ কর্তৃক অন্য অঙ্গের বিষয়ে কটাক্ষ করা কাম্য নয়। এ ধরনের কাজ গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকারক।

“সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ স্বাধীন বিচার বিভাগ নিশ্চিত করে। ৯৬ অনুচ্ছেদের আলোকে বিচারক অপসারণের বিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে না, বরং অধিক সুসহংত করে।”

স্পিকার বলেন, “৯৬ অনুচ্ছেদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রমাণিত অসামর্থ্য বা অসদাচরণ তদন্তে প্রমাণিত হতে হবে। প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি বা বিচারকের অসদাচরণ সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্র করতে পারবে। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সমর্থন প্রয়োজন।

“এই সকল উপাদান সমন্বয়ের মাধ্যমেই কেবল জাতীয় সংসদ কর্তৃক ৯৬ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করা যাবে। সে কারণে সংসদ কর্তৃক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে ৯৬ অনুচ্ছেদ ব্যবহার সম্ভব নয়।”

উচ্চ আদালতের সাবেক আইনজীবী শিরীন শারমিন বলেন, “সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা কেবলমাত্র তিনজন বিচারকের উপর ন্যস্ত রয়েছে। এক্ষেত্রে বিচারকের ভাগ্য তিন ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল। চিফ জাস্টিস ও অপর দুইজন সিনিয়র জজ। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে এবং তার প্রবণতা দেখা যায়।

“পাওয়ার করাপ্টস, অ্যন্ড অ্যাবসোলিউট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসোলিউটলি… আমরা ডেমোক্রেসিতে বাস করি, জুরিস্টোক্রেসিতে নয়।”

স্পিকার বলেন, “সংসদ সদস্যরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। আর নির্বাহী বিভাগ সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। বিচার বিভাগেরও দায়বদ্ধতা গুরুত্বপূর্ণ।“

“... অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের সামরিক ফরমানের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অবৈধ, অসাংবিধানিক।”

শিরীন শারমিন বলেন, “সংসদ গণতন্ত্রের হৃদপিণ্ড। সংসদ অকার্যকর এমন কথা বলা ক্রিয়াশীল গণতন্ত্র ও জনগণের জন্য অপমানজনক।”

বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বাতিলের রায় গত ১ অগাস্ট প্রকাশের পর এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনা তৈরি হয়।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা এই রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার পদত্যাগের দাবিও তোলেন।

অন্যদিকে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার আমলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনার এই রায়কে স্বাগত জানায় বিএনপি।

রায় প্রকাশের পর সংসদ বসলে তা নিয়ে আলোচনা হবে বলে ধারণাই ছিল রাজনৈতিক মহলে। বুধবার এই রায়ের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে একটি প্রস্তাব সংসদে পাস হয়।

স্পিকার বলেন, “সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা সংবিধান আইনসভার ওপর ন্যস্ত করেছে। আজকে জাতির সামনে যদি এমন কোনো চিত্র উপস্থাপন করা হয় যে, এখানে মানবাধিকার সঙ্কটাপন্ন, সংসদ অকার্যকর, প্রশাসনে অব্যস্থাপনা, ব্যাপক দুর্নীতি ও বিচার বিভাগ প্রায় ডুবন্ত, তা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবতা বিবর্জিত। বর্তমান বাংলাদেশকে কোনোভাবেই চিত্রায়িত করে  না। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, এটা কোনোভাবেই বাংলাদেশের চিত্র নয়। আজকের বাংলাদেশ বিশ্ব উন্নয়নের রোল মডেল।”

দশম সংসদ জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখছে দাবি করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ আজ গণতন্ত্রের এই অগ্রযাত্রা একদিনে অর্জিত হয়নি। “অনেক আন্দোলন সংগ্রাম, রক্তঝরা পথ বেয়ে আজকের গণতন্ত্র, আজকের সংসদ।…জাতির পিতা দিয়েছেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। আসুন গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখি।”

এরপর স্পিকার অধিবেশন সমাপ্তি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতির আদেশ পড়ে শোনান।

গত ১০ সেপ্টেম্বর এই অধিবেশন শুরু হয়। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে এই অধিবেশন পাঁচ কার্যদিবস চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় কার্য-উপদেষ্টা কমিটি।

এই অধিবেশনে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে প্রস্তাব গ্রহণের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।

সংসদ সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী এই অধিবেশনে মোট দুটি বিল পাস হয়। এছাড়া ৭১ বিধিতে পাওয়া ১৪৭টি নেটিশের মধ্যে ছয়টি নোটিশ গ্রহণ করা হয়, যার মধ্যে আলোচিত হয়েছে তিনটি।

অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর উত্তর দেওয়ার জন্য প্রশ্ন জমা পড়ে ৯৭টি। তার মধ্যে ৯টির জবাব দেন সংসদ নেতা। এছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের জন্য এক হাজার ৬৬৮টি প্রশ্ন জমা পড়ে, মন্ত্রীরা উত্তর দেন ৪৬৪টির।