খানা-খন্দে ভরা ঢাকার সড়কে চলতে কষ্ট

এবার ভারি বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার সড়ক, ভাঙা-চোরা অনেক সড়ক মেরামতের পর আবার ভাঙায় চলাচলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Sept 2017, 03:35 PM
Updated : 12 Sept 2017, 05:55 PM

সোম ও মঙ্গলবার যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, মৌচাক, মালিবাগ, মুগদা, বাসাবো, রামপুরা, বনশ্রী, গাবতলী এবং মিরপুরের কয়েকটি এলাকা ঘুরে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

বর্ষার শুরু থেকেই বনশ্রীর আইডিয়াল স্কুল থেকে রামপুরা টেলিভিশন সেন্টার পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সোমবার গিয়ে দেখা যায়, সড়ক ভেঙে যাওয়ায় বনশ্রীর ‘এ’ ও ‘বি’ ব্লকের মাঝখানের সড়ক থেকে রামপুরা পর্যন্ত সড়কের একপাশ দিয়ে ছোট কোনো যানবাহন যেতে পারছে না। সেগুলোকে উল্টোপথে পাঠাতে দেখা যায় সেখানে নিয়োজিত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের।

টেলিভিশন সেন্টারের সামনের ইউলুপের মুখে সড়কের অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছিল না, দেখা যায় শুধু কাদাপানি। সেখান দিয়ে কোনো যানবাহন যেতে পারছিল না। সড়ক বিভাজকের ওপর দিয়ে চলাচল করতে দেখা যায় কিছু যানবাহন।

সেখানে সোমবার দুপুরে একটি কুরিয়ার সার্ভিসের কভার্ডভ্যান আটকে যায় গর্তে। চালক আবুল কালাম বলেন, গর্ত এড়িয়ে চলতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন তিনি।

“গর্ত দেইখা ভাবছিলাম এই দিক দিয়া যাই, কিন্তু এইখানে আসার পর চাকা ডাইবা গেছে।”

দক্ষিণ বনশ্রীর বাসিন্দা মনির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সড়কের এ অবস্থার কারণে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের।

“আমাকে লেগুনায় করে আসতে হয়। ঝাঁকুনির চোটে যাত্রীরা একে অন্যের উপর গিয়ে পড়ে। প্রায়ই গাড়ির ছাদের সঙ্গে বাড়ি লাগে। আর এই অংশটুকু পার হতে এক ঘণ্টার বেশি লেগে যায়। আবার যানজট দেখে অনেক চালক আইডিয়াল স্কুলের কাছে নামিয়ে দেয়। তখন এই কাদাপানি মাড়িয়ে হেঁটে  আসতে হয়।”

প্রগতি সরনি ও রামপুরা এলাকার যানজটের জন্য ভাঙা সড়ককে দায়ী করছেন ট্রাফিক পুলিশের রামপুরা বিভাগের পরিদর্শক মো. সারোয়ার জাহান।

রাস্তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “খুব খারাপ অবস্থায় আছি। খুবই খারাপ অবস্থা রাস্তার। এত বড় বড় গর্ত হয়ে গেছে যে, ছোট গাড়ি সামনে যেতে চায় না। আমরা তো ভোগান্তিতে আছি, এই এলাকার হাজার হাজার লোক দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

“বাংলাদেশে যদি কোনো খারাপ রাস্তা থাকে তাহলে আইডিয়াল স্কুল থেকে রামপুরা এবং রামপুরা থেকে আবুল হোটেল হয়ে মালিবাগ পর্যন্ত।”

প্রগতি সরনির রামপুরা থেকে আবুল হোটেল পর্যন্ত একপাশে পয়োঃনিষ্কাশন নালা বসানো হচ্ছে। যেসব জায়গায় নালা বসানো হয়েছে, সেখানকার গর্ত ইটবালু দিয়ে ভরাট করা হলেও বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন জায়গায় খানাখন্দ তৈরি হয়েছে। একই অবস্থা উল্টোদিকের সড়কেও।

হাজিপাড়া সিএনজি ফিলিং স্ট্শেনের সামনের সড়কে গর্তগুলোয় পানি জমে থাকতে দেখা যায়। সেখান দিয়ে যানবাহন চলছিল ধীর গতিতে। আবুল হোটেল থেকে মালিবাগ রেলক্রসিং হয়ে মৌচাক পর্যন্ত রাস্তায়ও খানাখন্দ। মৌচাক থেকে মালিবাগ পর্যন্ত সড়কও ভাঙা।

একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপক কাজী মাহমুদ গত নয় মাস মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে বাসাবোর কর্মস্থলে আসেন। সড়কে ভোগান্তি নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন,“এইটা কোনো শহর না। মৌচাক-মালিবাগ এলাকা দিয়ে আসলে মনে হয়, আমরা কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরে বসবাস করছি।

“এমনিতেই পুরো সড়কে গর্ত। আর বৃষ্টি হলে তো অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। তখন কোন জায়গায় কতটুকু গর্ত সেটা বোঝার উপায় নেই। এই সড়কের বিকল্প হিসেবে রামপুরা দিয়ে যাতায়াতের চেষ্টা করেছিলাম। সেই সড়কেও অনেক জায়গায় ভেঙে একাকার হয়ে গেছে।”

শাহজাহানপুর থেকে রাজারবাগ হয়ে মালিবাগ পর্যন্ত সড়কের দুইপাশেও ভাঙা।

মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার হওয়ার পর যাত্রাবাড়ী থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত সড়কের দুপাশের অবস্থার আর উন্নতি হয়নি। যাত্রাবাড়ী থেকে চট্টগ্রাম মহাসড়কে যেতে সড়কের দুপাশে ছোটবড় অসংখ্য ভাঙন। সম্প্রতি যাত্রাবাড়ী আড়তের সামনের অংশে ঢালাই করে দেওয়ায় সেখানে ভাঙা কিছুটা কমেছে।

কুতুবখালী থেকে যাত্রাবাড়ীর দিকে আসার সড়কেও অনেক জায়গায় ভাঙা। যানবাহন চলে হেলে-দুলে। ভাঙা সড়কে সবাইকে দুর্ভোগ পোহাতে হয় বলে জানান শনিরআখড়া এলাকার রিকশাচালক সুলতান মিয়া।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এইদিকে রিকশা চালাইতে খুব কষ্ট। মানুষজন লিয়া আসতে পারি না, সবাই ঝাঁকি খায়। মাল লিয়াও আসতে পারি না। মোষের লাহান খাটনি করা লাগে। রাস্তাঘাট ভালা হইলে গাড়ি চালাইয়া শান্তি পাওয়া যায়।”

একই অবস্থা দেখা গেছে ঢাকা-ডেমরা সড়কের মৃধাবাড়ী পর্যন্ত। সড়কের এই অংশে অসংখ্য খানাখন্দ থাকায় যানবাহন চলে ধীরগতিতে।

বাসাবো থেকে মাদারটেকের প্রধান সড়কটিও দীর্ঘদিন ধরে ভাঙা। যাত্রাবাড়ী থেকে পোস্তগোলা যাওয়ার সড়কও বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে গেছে।

দোলাইরপাড়ের আবদুল্লাহ ফিলিং স্টেশনের সামনের সড়কের অনেকটা অংশ ভাঙা। জুরাইনের খন্দকার ফিলিং স্টেশনের সামনের রাস্তা ভাঙা। সেখান থেকে জুরাইন রেলক্রসিং হয়ে পোস্তগোলা সেতুর প্রান্ত পর্যন্ত সড়কে ভাঙন দেখা গেছে।

সেখানে ভেঙে যাওয়া অংশে ইট বিছিয়ে তার উপর দেওয়া পিচঢালাই বৃষ্টিতে ধুয়ে আবার বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে।

সড়কের এই অবস্থার কারণে যানবাহন ধীরগতিতে চলায় প্রায় সারা দিনই যানজট লেগে থাকে বলে জানান হিউম্যানহলার চালক ইব্রাহিম খলিল। তিনি বলেন, ভালোভাবে মেরামত না করায় তা আবার ভেঙে গেছে।

“কয়দিন আগে ইট দিয়া রাস্তা সমান কইরা দিসিল। কিন্তু বৃষ্টি আসার পর আবার ভাইঙ্গা গেছে। এই রাস্তা সারা বছরই ভাঙা থাকে।”

গেণ্ডারিয়া থেকে দয়াগঞ্জ যাওয়ার সড়কেও বিভিন্ন অংশে ভাঙা-চোরা দেখা গেছে। গেণ্ডারিয়া রেলস্টেশনের সামনে থেকে মীরহাজিরবাগ একতা সংঘ পর্যন্ত সড়কে অসংখ্য খানাখন্দ। অনেক জায়গায় পানি জমে থাকতে দেখা গেছে।

পুরান ঢাকার জয়কালী মন্দির থেকে বঙ্গভবনের দক্ষিণপাশের সড়ক হয়ে গুলিস্তান পার্কের কোণা পর্যন্ত অসংখ্য ভাঙন। অতীশ দীপঙ্কর সড়কের মানিকনগর থেকে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম পর্যন্ত সড়কও খানাখন্দে ভরা। বেশি খারাপ অবস্থা মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম সিগন্যালে। এছাড়া কমলাপুর মাঠ থেকে কমলাপুর রেলস্টেশনের সামনের সড়কেও অনেক জায়গায় ছোট-বড় গর্ত দেখা গেছে।

ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর থেকে রাসেল স্কয়ার পর্যন্ত সড়কের অনেক জায়গায় ভাঙা-চোরা। ২৭ নম্বর থেকে আড়ং হয়ে আসাদগেট পর্যন্ত সড়কেও রয়েছে ছোটবড় অসংখ্য গর্ত।

আসাদগেট থেকে শ্যামলী পর্যন্ত সড়কে তেমন ভাঙা-চোরা না থাকলেও অনেক জায়গায় উঁচু-নিচু। কল্যাণপুর থেকে গাবতলী পর্যন্ত সড়কের একপাশে ভাঙা। সড়কে নিষ্কাশন নালা করার পর মেরামত করা হয়েছিল। সে অংশে আবার ভেঙেছে।

টেকনিক্যাল মোড় থেকে গাবতলী বাসস্ট্যান্ড হয়ে গরুর হাট পর্যন্ত ভাঙা অংশ মেরামত করা হলেও উঁচুনিচু হওয়ায় ঝাঁকুনি খেতে হয়।

গাবতলী থেকে মাজার রোডে আসতে সড়কের বাঁ পাশেও অনেক জায়গায় ঢালাই উঠে গর্ত হয়ে গেছে। সেখান থেকে টেকনিক্যাল পর্যন্ত অনেক জায়গায় ভাঙন।

বেশি খারাপ অবস্থা মিরপুর রোড থেকে মাজার রোডের মিরপুর সেকেন্ড কলোনি এলাকা পর্যন্ত। এ সড়কে তিতাস গ্যাসের পরিবহন অফিস থেকে মিরপুর রোড পর্যন্ত একপাশে নিষ্কাশন নালা বসানোর পর গর্ত ভরাট করে ইটের খোয়া ফেলা হয়েছে। তবে বৃষ্টিতে এর বেশিরভাগই উঠে গিয়ে বিভিন্ন অংশে গর্ত তৈরি হয়েছে।

মাজার রোড এলাকায় কথা হয় অটোরিকশাচালক আইনুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, কয়েকটি প্রধান সড়ক বাদে বেশিরভাগ সড়কই খানা-খন্দে ভরা।

“শহরের রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব খারাপ। মিরপুর, মালিবাগ, রামপুরা এলাকায়ও যাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। অন্য রাস্তায়ও ছোডছোড গর্ত। কয়দিন পর নষ্ট হয় সিএনজি (অটোরিকশা)। শহরে গাড়ি চালাইয়া শান্তি নাই।”

মিরপুরের শাহ আলী মাজারের আগে-পরে সড়কের প্রায় ১০০ মিটার অংশ ভাঙা। মাজার থেকে মিরপুর ১ নম্বর হয়ে সনি সিনেমা হল পর্যন্ত সড়কেও অনেক জায়গায় গর্ত। ভেঙে গর্ত হয়ে গেছে চিড়িয়াখানা সড়কের রাইনখোলায়। কমার্স কলেজ সড়কের রাইনখোলা থেকে হাজী রোডের মোড় পর্যন্ত তিন মাস আগে পাইপ বসানো হলেও সড়ক এখনও মেরামত করা হয়নি। সেখানে অসংখ্য খানাখন্দ। এ সড়কের শিয়ালবাড়ি থেকে প্রশিকা মোড় পর্যন্ত ভাঙা।

মিরপুর ১০ নম্বর থেকে ১২ নম্বর পর্যন্ত রাস্তা খুঁড়ে রাখায় বিভিন্ন জায়গায় গর্ত তৈরি হওয়ায় যানবাহন চলছে ধীরে। ১২ নম্বর বাসস্ট্যান্ডের সামনের সড়কে গর্তের সংখ্যা অনেক বেশি।

তেজগাঁওয়ের তিব্বত বাসস্ট্যান্ড থেকে নাবিস্কো হয়ে মহাখালী পর্যন্ত সড়কও খানাখন্দে ভরা। এ সড়কের বিভিন্ন অংশে ইট দিয়ে গর্ত ভরাট করা হলেও সেখানে আবার ভেঙেছে। বেশি খারাপ অবস্থা তেজগাঁও-গুলশান লিঙ্ক রোড সিগন্যালে। মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে রসুলবাগ পর্যন্ত সড়কেও ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় সড়ক প্রায় এক হাজার কিলোমিটার। এরমধ্যে ১৫৮ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন অংশ অতিবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ডিএসসিসির প্রকৌশল শাখা থেকে জানা গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব সড়ক উন্নয়নে ২৬৯ কোটি টাকা চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

অতিবৃষ্টিতে পানি জমে সড়কগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ফরাজী শাহাবউদ্দিন আহমেদ।

তিনি মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পানি হলো বিটুমিনাস কার্পেটিংয়ের শত্রু। পানি জমে থাকলে কার্পেটিং নষ্ট হয়ে যায়, এর উপর দিয়ে ভারী যানবাহন চললে রাস্তা ভেঙে যায়।”

ঢাকা দক্ষিণের সব সড়কের ক্ষতির পরিমাণ এখনও নির্ধারণ করতে পারেননি বলে জানান ফরাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। আঞ্চলিক নির্বাহী প্রকৌশলীদের জরিপ করতে নির্দেশ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এক হাজার ২০০ কিলোমিটার সড়কের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সড়ক ভাঙা বলে জানান ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কুদরত উল্লাহ।

“সবগুলো রাস্তা মেরামতেই আমাদের প্রোগ্রাম নেওয়া আছে। আমরা নিজেরা করব। যদি অর্থের বেশি প্রয়োজন হয় তাহলে মন্ত্রণালয় থেকে নেব। আমাদের কাজ থেমে থাকবে না,” বলেন তিনি।