রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ দেওয়ার উপর সংসদে গৃহীত প্রস্তাবের উপর আলোচনায় একথা জানান বাংলাদেশের সরকার প্রধান।
তিনি বলেন, “আমি জাতিসংঘ অধিবেশনে যাচ্ছি। সেখানে সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য দেব। নিশ্চয়ই আমার বক্তব্যে মিয়ানমারের বিষয়টি তুলে ধরব।”
রোহিঙ্গা সঙ্কটের মিয়ানমারের ভূমিকার সমালোচনামুখর বিভিন্ন দেশ। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তায়িপ এরদোয়ানও এই বিষয়টি এই মাসে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘ অধিবেশনে তুলবেন বলে ঘোষণা এসেছে।
মুসলিম দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে শেখ হাসিনা বলেন, “বিশ্বব্যাপী যেন মুসলমানদের উপর আক্রমণ করার একটা মানসিকতা দেখতে পাচ্ছি। মুসলমানরা সব রিফিউজি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে সেখানে। আইলানের লাশ দেখেছি সাগর পাড়ে, নাফ নদীতে দেখি শিশুদের লাশ। কেন?
“সমস্ত মুসলিম উন্মাহ যদি এটা অনুভব করতে পারত আর একমত থাকতে পারত, তাহলে মুসলমানদের উপর এই অত্যাচারটা কেউ করতে পারত না।”
রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এনিয়ে সাধারণ অধিবেশনে আলোচনা প্রত্যাশা করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও।
বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা মিয়ানমারের সমালোচনার পাশাপাশি লাখ লাখ রোহিঙ্গাতে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসাও করছে।
‘সমাধান মিয়ানমারের হাতে’
সংসদে শেখ হাসিনা বলেন, “এ সমস্যা মিয়ানমার সৃষ্টি করেছে, তাদেরকেই সমাধান করতে হবে।”
সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের কোনো সহযোগিতার দরকার হলে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তা করবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।
মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়ে দশকের পর দশক ধরে ৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছে। এবার সহিংসতা শুরুর পর আরও ৩ লাখ এসে পড়েছে।
আগের এবং এবার আসা সব রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
“আমাদের এখানে যারা দীর্ঘদিন থেকে আশ্রয় নিয়ে আছে এবং এবার যারা এসেছে; তাদের প্রত্যেক নাগরিককে ফিরিয়ে নিতে হবে।”
মুসলিম রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবসনের ব্যবস্থা করা এবং তাদের সুরক্ষায় মিয়ানমারে ‘সেইফ জোন’ প্রতিষ্ঠা করতে বলেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
এক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান নেতৃত্বাধীন কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের উপর জোর দেন তিনি।
“কফি আনান কমিশন তো তারাই (মিয়ানমার) গঠন করিয়েছে। তাহলে তার সুপারিশটা তারা গ্রহণ করবে না কেন? আর সেখানে কোনো আপত্তি থাকলে তারা আলোচনা করে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে।”
“আমরা রোহিঙ্গাদের যে আশ্রয় দিয়েছি; এটা সাময়িক ব্যবস্থা। মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদের নাগরিকদের নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে নিতে হবে।”
রাখাইন (এক সময়ের আরাকান) রাজ্যের মুসলিম রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে মানতে নারাজ মিয়ানমার সরকার। তারা এদের বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে দেখে।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের শত বছরের ইতিহাস তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “রোহিঙ্গারা তাদেরই নাগরিক। ধাপে ধাপে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিচ্ছে। এখন তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করছে।”
মানবিক কারণে তাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “ছোট ছোট শিশু-নারী….আমরা তো অমানুষ হতে পারি না, অমানবিক হতে পারি না।”
কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বার বার আহ্বানেও মিয়ানমার সরকারের কোনো সাড়া মেলেনি।
এখনও তারা সাড়া দিচ্ছে না বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, উল্টো তাদের বাঙালি বলে অপপ্রচার চালিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে মিয়ানমার।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ আখ্যায়িত করার সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তারা তো বার্মিজ। তাদের কেন বাঙালি বলে কালার দেওয়া হবে? তারা তো শত শত বছর ধরে মিয়ানমারে থেকেছে। সেটা তো তাদের আদি নিবাস।”
‘দোষ সু চির নয়’
সংসদে সাধারণ আলোচনায় অনেকেই অং সান সু চির সমালোচনা করেন, নোবেলবিজয়ী মিয়ানমারের নেত্রী এখন রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে সারাবিশ্বেই সমালোচনার মুখে রয়েছেন।
সু চির পক্ষে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “এখানে অনেকে অং সান সু চির কথা বলেছেন। মিয়ানমারে দীর্ঘদিন সামরিক জান্তা ক্ষমতায় ছিল। মিয়ানমারে এখন কেবল গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু। সেখানে আইন করে সু চিকে কিন্তু রাষ্ট্রপতি বা সরকার প্রধান হতে দেয়নি। তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।”
আধুনিক মিয়ানমারের স্থপতির মেয়ে সু চির প্রকৃত ক্ষমতা বিবেচনা করতে সবার প্রতি অনুরোধ জানান বাংলাদেশের জাতির জনকের মেয়ে হাসিনা।
তিনি বলেন, “তিনি যে ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন.. ওখানে সংসদেও কিন্তু মিলিটারি প্রতিনিধি বেশি। পলিসি মেকিংয়ে তারা যেটা বলবে সেটাই।”
‘অত্যাচারের সুযোগ করে দিয়েছে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা’
রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনকে অমানবিক বললেও এই পরিস্থিতির সূত্রপাত ঘটানোর জন্য রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের দায়ী করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
দুই সপ্তাহ আগে রাখাইনে সেনা ও পুলিশ চৌকিকে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির হামলার পর শুরু হয় সেনা অভিযান। এই দলটিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত করেছে মিয়ানমার সরকার।
শরণার্থীরা বলছে, সেনা অভিযানে নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হচ্ছে, পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘর। সীমান্তে মাইনও পেতে রাখা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, “তারা (রোহিঙ্গা বিদ্রোহী) ১০ জন পুলিশ আর পাঁচ জন আর্মি মেরে কী অর্জন করল? এতে করে তাদের মা-বোনরাই তো অত্যাচারিত হচ্ছে। অত্যাচারের সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে; কী অর্জন করতে পেরেছে তারা?”
এই ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধের দাবি জানান তিনি।
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান চালাতে মিয়ানমারকে আহ্বান জানালেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ার কথাও সংসদে জানান শেখ হাসিনা।
‘রোহিঙ্গা নিয়ে ফায়দা লোটা নয়’
শরণার্থীদের নিয়ে বাংলাদেশের কেউ যেন রাজনৈতিক বা আর্থিক ফায়দা লুটতে না পারে, সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছেন শেখ হাসিনা।
“তারা কষ্ট করে আজ আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এদের দুর্ভোগের সুযোগ নিয়ে কেউ যেন রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টা না করে। কেউ যেন আর্থিক সুযোগ নিয়ে নিজেদের ভাগ্য গড়ার চেষ্টা না করে।”
তিনি বলেন, “সাহায্য নেই সহযোগিতা নেই- এক একখানা বড় বড় স্টেটমেন্ট দেবে, সেটা আমরা চাই না। ১৬ কেটি মানুষকে আমরা খাবার দিই। তার সাথে এরকম আরও দুই, চার, পাঁচ লাখ লোককে খাবার দেওয়ার মতো শক্তি বাংলাদেশের রয়েছে।”
সরকারি ব্যবস্থাপনায় রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের উদ্যোগের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “রোহিঙ্গা যারা ঢুকবে তাদের প্রত্যেকের ছবি তোলা, নাম-ঠিকানা লেখা…তার সম্পূর্ণ হিসাব আমরা করতে শুরু করেছি।”