বিচার বিভাগ যথেষ্ট ধৈর্য ধরছে: প্রধান বিচারপতি

অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা নিয়ে আলোচনার আহ্বানে সরকারের সাড়া না পেয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে সর্বোচ্চ আদালত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 August 2017, 05:26 AM
Updated : 20 August 2017, 10:39 AM

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা রোববার শুনানিতে উপস্থিত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে বলেছেন, “বিচার বিভাগ যথেষ্ট ধৈর্য ধরছে।”

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা প্রসঙ্গে বিচারপতি সিনহা সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে অযোগ্য ঘোষণা করে সে সেদেশের সুপ্রিম কোর্টের রায় দেওয়ার পরের পরিস্থিতি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, “আমাদের আরও পরিপক্কতা দরকার।”

বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে বিচার বিভাগের সঙ্গে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের দীর্ঘ টানাপড়েনের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ওই বিধিমালার খসড়া সুপ্রিম কোর্টে জমা দিলেও প্রধান বিচারপতি গত ৩০ জুলাই তা গ্রহণ না করে কয়েকটি শব্দ ও বিধি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

ওই খসড়া গ্রহণ না করে প্রধান বিচারপতি মতপার্থক্য নিরসনে আইনমন্ত্রী, অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইন মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় ডাকলেও আইনমন্ত্রী এখন পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে যাননি।

চাকরিবিধির ওই গেজেট প্রকাশের জন্য গত ৬ অগাস্ট সরকারকে দুই সপ্তাহ সময় দিয়েছিল আপিল বিভাগ। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রোববার আবারও সময়ের আবেদন করেন।

এ বিষয়ে শুনানির পর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারকের আপিল বেঞ্চ ৮ অক্টোবর পর্যন্ত সময় মঞ্জুর করে। গেজেট প্রকাশের জন্য এ নিয়ে ২৫ বার সময় পেল রাষ্ট্রপক্ষ।

শুনানির শুরুতে প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে আলোচনায় বসার আহ্বানের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, “গত তারিখে কি কথা ছিল? কার সঙ্গে কে কে থাকবে তা ঠিক করে আলাপ-আলোচনা করার কথা ছিল।  কে কে থাকবে?”

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “ল মিনিস্টার।”

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, “এতই আমরা ইয়ে হয়ে গেলাম… আলোচনা পর্যন্ত করলেন না?”

বিচারপতি সিনহা বলেন, “আপনারা মিডিয়াতে অনেক কথা বলেন।  কোর্টে এসে অন্য কথা বলেন। আপনাদের বলছি, আপনাকে নয়।  আপনিই বলেন।  কবে কি হবে?”

অ্যাটর্নি জেনারেল তখন বলেন, “একটা আনস্টেবল সিচুয়েশন তৈরি হয়ছে।”

তখন প্রধান বিচারপতি সেই ‘আনস্টেবল সিচুয়েশনের’ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “সবটা নিয়েই আমি বিব্রত।”

বিচারপতি সিনহা বলেন, “আপনারা ঝড় তুলছেন।  আমরা কোনো মন্তব্য করেছি?”

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “না, আপনারা করেননি।”

এরপর প্রধান বিচারপতি গেজেট প্রকাশের জন্য সময় মঞ্জুর করে বলেন, “আপনার চাওয়া মত ৮ তারিখ রাখলাম।”

এ মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম এ সময় তার আবেদনের শুনানির আরজি জানান।

জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমরা বিচার বিভাগ ধৈর্য ধরছি।  যথেষ্ট ধৈর্য ধরছি।  আজকে একজন কলামিস্টের লেখা পড়েছি… সেখানে ধৈর্যর কথাই বলা হল। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট প্রধানমন্ত্রীকে ইয়ে (অযোগ্য) করল। সেখানে কিছুই (আলোচনা-সমালোচনা) হয়নি। আমাদের আরও পরিপক্কতা দরকার।”

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম পরে নিজের দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, “নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির ব্যাপারে যে রুলস ফ্রেম করার কথা, সে বিষয়টি আজ আদালতের কার্যতালিকায় ছিল।  আমি আদালতকে বলেছি, যেহেতু নানা কারণে এখন অবস্থা খুব উত্তপ্ত, সুতরাং রুলস ফ্রেমিংয়ের ব্যাপারে লম্বা সময় দেওয়া হোক। যাতে এর মধ্যে সার্বিক অবস্থাটা স্থিতি লাভ করে। তখন আদালত ৮ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দিয়েছে।

“তখন আদালত বলেছে, গত তারিখে কথা ছিল আমাদের সঙ্গে আপনারা বসবেন। তখন আমি বলেছি, আমার তো বসার কথা না, আমি তো এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না। যাই হোক, যদি এরকম কথা হয়ে থাকে, তাহলে ফের উদ্যোগ নেব।”

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আমি সব সময়ই বলি, আমি পলিসি মেকার না। এক্সিকিউটিভ ব্রাঞ্চ এবং জুডিশিয়ারির সাথে একটা সংযোগ রক্ষা করি মাত্র। আমাকে বলা হয় একটা ব্রিজ।” 

ঘটনাক্রম

মাসদার হোসেন মামলার চূড়ান্ত শুনানি করে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করতে ঐতিহাসিক এক রায় দেয়।

ওই রায়ে আপিল বিভাগ বিসিএস (বিচার) ক্যাডারকে সংবিধান পরিপন্থি ও বাতিল ঘোষণা করে। একইসঙ্গে জুডিশিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র সার্ভিস ঘোষণা করা হয়। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার জন্য সরকারকে ১২ দফা নির্দেশনা দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। আপিল বিভাগের নির্দেশনার পর গত বছরের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়।

সরকারের খসড়াটি ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার অনুরূপ হওয়ায় তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থি বলে গত ২৮ আগাস্ট শুনানিতে জানায় আপিল বিভাগ।

এরপর ওই খসড়া সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্ট আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেইসঙ্গে তা চূড়ান্ত করে প্রতিবেদন আকারে আদালতে উপস্থাপন করতে বলা হয় আইন মন্ত্রণালয়কে।

এরপর দফায় দফায় সময় দেওয়া হলেও সরকার মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে ওই বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ না করায় গত ৮ ডিসেম্বর দুই সচিবকে তলব করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

দুই সচিবের হাজিরার আগে ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে একটি নোটিসে বলা হয়, নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ সংক্রান্ত বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে রাষ্ট্রপতি ‘সিদ্ধান্ত’ দিয়েছেন।

আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক পরদিন আদালতের তলবে হাজির হলে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিধিমালা নিয়ে “রাষ্ট্রপতিকে ভুল বোঝানো হয়েছে।”

সেদিন শুনানি করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মাধ্যমে সরকারকে নির্দেশ দেয় আপিল বিভাগ। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বারবার সময় নেওয়া হচ্ছিল।

এর মধ্যে জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেন আইনমন্ত্রী। তার ধারাবাহিকতায় তিনি ২৭ জুলাই সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে চাকরিবিধির খসড়া দিয়ে এলেও সর্বোচ্চ আদালত তা গ্রহণ করেনি।