বন্যার খাঁড়ায় মধ্যাঞ্চলও

বৃষ্টি কমলেও উজানে পানির স্রোত কমেনি বলে উত্তরাঞ্চলের ১০ জেলা এখন বন্যাকবলিত। এক সঙ্গে সব নদীর পানি বাড়তে থাকায় মধ্যাঞ্চলেও বিস্তৃত হচ্ছে বন্যা।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 August 2017, 05:00 PM
Updated : 13 August 2017, 08:32 PM

অগাস্টের শেষে ফের ভারি বর্ষণ হলে সেপ্টেম্বর নাগাদ অন্তত ২৫ জেলায় বন্যার বিস্তার ঘটবে বলে আভাস দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

এই পূর্বাভাস ধরে প্রস্ততি ইতোমধ্যে নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ।

তিনি রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আবহাওয়া অধিদপ্তর, বন্যা পূর্বাভাস সতর্কীকরণ কেন্দ্র ও স্পারসো যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তাতে এবার মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত বন্যার বিস্তার ঘটবে।”

এবার বর্ষা মৌসুমে মধ্য জুলাইয়ে প্রায় একডজন জেলায় বন্যার বিস্তার ঘটলে সাড়ে ছয় লাখ লোক পানিবন্দি হয়ে পড়ে। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

মাঝে কয়েকদিন বিরতি দিয়ে অগাস্টের শুরু থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের বন্যা চলছে এখন দেশের উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ১০ জেলায়।

দিনাজপুরে বন্যার মধ্যে একদিনেই পানিতে ডুবে অন্তত সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। কুড়িগ্রামে মৃত্যু হয়েছে ছয়জনের, পানিবন্দি প্রায় ৪ লাখ মানুষ। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটায় ঢুকে পড়েছে বন্যার জল। নওগাঁর বিভিন্ন এলাকাও বন্যা কবলিত এখন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৯০টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে রোববার ৭৭টি পয়েন্টেই পানি বেড়েছে। এর মধ্যে ধরলা, তিস্তা, যমুনেশ্বরী, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ধলেশ্বরী, পুনর্ভবা, টাঙ্গন, আত্রাই, সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, যদুকাটা, সোমেশ্বরী ও কংস বিপদসীমার উপরে বইছে।

বন্যার পনিতে ঘর-বাড়ি ডুবে যাওয়ায় বিপাকে মানুষ।ছবিটি রোববার সদর উপজেলার বরুনাগাঁও ঘাটপাড়া এলাকা থেকে তোলা।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, প্রধান তিনটি নদ-নদীর অববাহিককায় পানি বাড়ছে। এতে বন্যার বিস্তৃতির শঙ্কা বাড়ছে। আরও তিন-চার দিন পানি বাড়লে বন্যার বিস্তার মধ্যাঞ্চলেও হবে।

প্রস্তুতি নিয়ে অধিদপ্তরের এক নির্দেশনায়ও বলা হয়, “একই সময়ে তিন অববাহিককায় পানি বাড়ার কারণে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট জেলায় চলমান বন্যা গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলায় বিস্তৃত হবে। পাশাপাশি মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণ মধ্যাঞ্চলে বিস্তৃত হবে।”

যমুনা কিংবা সুরমা-কুশিয়ারার পানি মেঘনা হয়েই বঙ্গোপসাগরে যাবে। ফলে এখন যে পানি নামতে দেরি হচ্ছে, তাতে ফের বর্ষণ হলে পরিস্থিতির অবনতি হবে।

অগাস্টের শেষ দিকে ফের অতিবর্ষণের পূর্বাভাস রয়েছে।

রিয়াজ আহমেদ বলেন, “জুলাইয়ের প্রথম দফা বন্যার ক্ষয়ক্ষতির রেশ কাটতে না কাটতে ভরা বর্ষার দ্বিতীয় ধাপের বন্যা একটু দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।”

বন্যার পানিতে লালমনিরহাট-বুড়িমারি রেল লাইন প্লাবিত হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে রেল যোগাযোগ।

পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইতোমধ্যে ২০ জেলায় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়।

এর মধ্যে রয়েছে দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, রাঙামাটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জ। এর বাইরে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নওগাঁ, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি এলাকায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মানিকগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জকেও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি রাখতে বলা হয়েছে।

বন্যার পানিতে বাড়ি-ঘর ডুবে যাওয়ায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে মানুষ। ছবিটি রোববার কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের জগমোহনের চর থেকে তোলা।

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রিয়াজ জানান, বন্যা কবলিত ৭ জেলায় ১০৭৫ মেট্রিক টন চাল এবং ৪৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আক্রান্ত সব জেলায় ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হবে।

বন্যার বিস্তার ঘটলেও ১৯৮৮ কিংবা ১৯৯৮ সালের মতো ভয়াবহ রূপ এবার নেবে না বলে মনে করছেন রিয়াজ আহমেদ।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মোহন কুমার দাস বলেন, বন্যার অবনতি ভয়াবহ হবে কি না, সে ধারণ পেতে আরও কয়েকদিন দেখতে হবে।

গত কয়েক দশকে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল ১৯৯৮ সালে, তখন ৬৮ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে গিয়েছিল। ১৯৮৮ সালের বন্যায় প্লাবিত হয় ৬১ শতাংশ এলাকা। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। ২০১৩ সালে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতে মাত্র ১০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। ২০১৫ সালে প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল।

বন্যা কবলিত জেলা সরেজমিন পরিদর্শন ও পরিস্থিতি তদারকির জন্যে অধিদপ্তরের ৫ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) এবং সংশ্লিষ্ট মাঠ পর্যায়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটিও বাতিল করা হয়েছে।