মনে হচ্ছে আমরা জাজেস রিপাবলিক অব বাংলাদেশে: বিচারপতি খায়রুল হক

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক; ওই রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কিছু পর্যবেক্ষণ নিয়ে করেছেন কঠোর সমালোচনা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 August 2017, 03:11 PM
Updated : 9 August 2017, 05:28 PM

সর্বোচ্চ আদালতের ওই রায়কে তিনি বলেছেন ‘পূর্ব ধারণা প্রসূত’, সংসদ সদস্যদের নিয়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণকে তার ‘অপ্রাসঙ্গিক’ মনে হয়েছে, শব্দ চয়নে তিনি দেখতে পাচ্ছেন ‘অপরিপক্কতা’।    

২০১০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১১ সালের মে পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করা খায়রুল হক বুধবার আইন কমিশনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু প্রজাতন্ত্র, সেহেতু জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সংসদের কাছে বিচারকদেরও জবাবদিহিতা থাকার কথা। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ফলে তা আর থাকল না।

“আমরা এতকাল জেনে এসেছি, দিস ইজ পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ, কিন্তু এ রায়ের পরে মনে হচ্ছে, উই আর নো লংগার ইন দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ। উই আর রাদার ইন জাজেস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ।”

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত।

এক রিট মামলার রায়ে হাই কোর্ট গতবছর ওই সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করলে গত ৩ জুলাই আপিলের রায়েও তা বহাল থাকে। গত ১ অগাস্ট আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জানা যায়, ৯৬ অনুচ্ছেদের ছয়টি ধারা পুনর্বহাল করার মধ্যে দিয়ে সামরিক সরকারের করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান ফিরিয়ে এনেছে সর্বোচ্চ আদালত।

মোট ৭৯৯ পৃষ্ঠার এই রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন।

ওই রায়ের পর গত এক সপ্তাহে সরকারের আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বৃহস্পতিবার এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করার কথা রয়েছে। তার আগেই বুধবার আইন কমিশনের সংবাদ সম্মেলনে বিচারপতি খায়রুল হকের প্রতিক্রিয়া এল।  

তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। কোনো রায় প্রকাশ হওয়ার পর যে কেউ তা নিয়ে আলোচনা করতে পারে।

বিচারপতি খায়রুল হক ছাড়াও আইন কমিশনের সদস্য বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির ও মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা ফওলুল আজিম উপস্থিত ছিলেন এ সংবাদ সম্মেলনে।

‘অপরিপক্ক’

ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে ‘মূল বিচার্য বিষয়কে পাশ কাটিয়ে’ সংসদ, নির্বাচন কমিশন নিয়ে যেসব প্রসঙ্গ এসেছে, তা ‘বাঞ্ছনীয় ছিল না’ বলে মনে করেন বিচারপতি খায়রুল হক।

তিনি বলেন, “অনারেবল চিফ জাস্টিস যদি বলেন, পার্লামেন্ট ইজ ইমম্যাচিউর বা সংসদ সদস্যরা অপরিপক্ক, তাহলে তো আমাকে বলতে হয়, অভিয়াসলি লজিক্যালি চলে আসে, সুপ্রিম কোর্টের জজ সাহেবরাও তাহলে ইমম্যাচিউর। কারণ তারাও তাদের রায়ের মধ্যে সংসদ সদস্যদের বিষয়ে বলেছেন, যা তাদের বলার দরকারই ছিল না।

“হাই কোর্টের রায়ে বলার কারণে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগকে এক্সপাঞ্জ পর্যন্ত করতে হয়েছে। তার মানে, সুপ্রিম কোর্টকে যদি হাই কোর্ট বিভাগের রায়ের অংশ বিশেষ এক্সপাঞ্জ করতে হয়, তাহলে তো এটা দৃশ্যমান যে এটি হাই কোর্ট বিভাগের বিচরপতিদের অপরিপক্কতা।  না হলে এক্সপাঞ্জ করার প্রয়োজনীয়তা কেন থাকবে?”

পরস্পরের প্রতি সম্মান না রেখে একে অপরের প্রতি অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার করলে তা দুই পক্ষেরই অপরিপক্কতার প্রমাণ দেয় বলে মন্তব্য করেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান।

“রায়ের ২২৩, ২২৪ এবং আরও অনেক জায়গায় ডেরোগোটরি রিমার্ক করা হয়েছে। বিচারক এমন কথাও বলেছেন, এমপি হওয়ার আগে তাদের কনসিডার করা উচিৎ যে তারা এমপি হওয়ার যোগ্য কি না। তিনি এমপি হওয়ার যোগ্য কি না সেটা তো যারা ভোটার তারা বুঝবে। সর্বোচ্চ আদালত থেকে এ ধরনের মন্তব্য মেনে নেওয়া যায় না।

“এমপি সাহেবরা এখন যদি উল্টো করে বলেন, হাই কোর্টের জাজরা বিচারপতি হওয়ার উপযুক্ত কিনা, সেটা তারা বিবেচনা করে দেখেছেন কিনা- কেমন শোনাবে? কথায় তো কথা বাড়ে।  এ ধরনের অপ্রাসঙ্গিক কথা কেন অ্যাপেক্স কোর্টের রায়ে আসবে? আসাটা বাঞ্ছনীয় নয় বলে আমি এবং আমরা মনে করি।”

রায়ের ২২৮ পৃষ্ঠায় পার্লামেন্টকে ‘ডিসফাংশনাল’ হিসেবে বর্ণনা করে যে পর্যবেক্ষণ আপিল বিভাগ দিয়েছে, তারও সমালোচনা করেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি।

“এটা সঠিক কথা হল না। পার্লামেন্ট ইজ ভেরি মাচ ফাংশনাল। তারা অর্থবিল পাস করেছে, তারা বিচারপতিদের বেতনভাতাদি পাস করছে, তারা সব কাজই তো করছে। ওই কথাটি প্রয়োজনীয়?... সংসদ কার্যকর কি কার্যকর না, এই বিষয়টার সঙ্গে ইস্যুর কোনো সম্পর্ক আছে? এ সমস্ত কথায় বরং বিচারপতিদের অপরিপক্কতা প্রকাশ পায়।”

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, ফাইল ছবি

পূর্ব ধারণা প্রসূত?

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে সংসদের হাতেই ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সময়ে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়।

পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী এনে বিচারক অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির ভার দিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেন।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরে গেলেও আপিল বিভাগের রায়ে তা বাতিল হয়ে যায়।

ষোড়শ সংশোধনীকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করে ওই রায়ে বলা হয়েছে, ওই সংশোধনীর আগে যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ব্যবস্থা ছিল, তা পুনঃস্থাপিত হল। 

কোনো বিচারক শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে দায়িত্ব পালনের অযোগ্য হয়ে পড়লে বা তার বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ উঠলে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এই কাউন্সিল তদন্ত করে সুপারিশ দেবে এবং তার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি ওই বিচারককে অপসারণের ব্যবস্থা নেবেন।

বিচারকদের জন্য ৩৯ দফার নতুন আচরণবিধি ঠিক করে দিয়ে আপিল বিভাগ রায়ে বলেছে, এই আচরণবিধি মেনে না চললে তা বিচারকের অসদাচরণ বলে গণ্য হবে।

ওই রায় প্রকাশের পর গত রোববার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার কার্যালয়ে কাউন্সিলের প্রথম সভা হয় বলেও সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।

আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বলছেন, এই রায়ের বিষয়টি শুনানির আগেই প্রধান বিচারপতির মনে একটি ধারণা হিসেবে ছিল বলে তার মনে হয়েছে।

“এ রায় হওয়ার অনেক আগে থেকেই, হিয়ারিংয়ের অনেক আগে থেকেই আমরা এটা খেয়াল করেছি যে, অনেক বিচারপতি সেমিনারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে ডেরোগেটরি মার্ক করেন। তাহলে কি রায় হওয়ার আগেই তাদের এটি পূর্বপকিল্পনা ছিল যে, সংসদ অকার্যকর, সংসদ সদস্যরা অপরিপক্ক, অশিক্ষিত, অজ্ঞ? 

“এই কথাগুলো তো খবরের কাগজে আপনাদের মাধ্যমে পড়েছি। রায়ের হেয়ারিংয়ের আগে থেকেই যদি উনি কথাগুলো বলে থাকেন তাহলে তো বলা চলে এ রায়, হিয়ারিং সবই প্রিকনসিভড ছিল। উনার মনের মধ্যেই তো এটা ছিল, এর জন্য তো শুনানি করা লাগে না।  এটা তো আর যাই হোক, একজন জাজের বিহেভিয়ার বলে মনে হয় না।”

২০১০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১১ সালের মে পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন খায়রুল হক

‘হাতিয়ার করা হচ্ছে’

আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, আপিল বিভাগের ওই রায়ে স্পষ্ট করে বলা না হলেও ‘বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে’ যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল না থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হয়ে যাবে। কিন্তু এর সঙ্গে তিনি একমত নন। 

“পঁচাত্তরে চতুর্থ সংশোধনীর আগ পর্যন্ত এ কথা কেউ বলতে পারবে না যে, আমাদের ইনডিপেন্ডেন্স অব জুডিশিয়ারি ছিল না। অনুচ্ছেদ ৯৬ থাকা সত্ত্বেও তখন ইনডিপেন্ডেন্স অব জুডিশিয়ারি ছিল। এখন বলা হচ্ছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল না থাকলে ইনডিপেন্ডেন্স অব জুডিশিয়ারি থাকবে না। 

“আমার বক্তব্য স্পষ্ট, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সঙ্গে ইনডিপেন্ডেন্স অব জুডিশিয়ারির সে রকম কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এটি ইনডিপেন্ডেন্স অব জুডিশিয়ারির মোড়কে হাতিয়ার হিসেবে করা হচ্ছে।” 

এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, প্রজাতন্ত্র বা রিপাবলিকের মালিক হল জনগণ এবং জনগণই সার্বভৌম। এই সার্বভৌম জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে সংসদ। এই সংসদের কাছে প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক কর্মচারীর জবাবদিহিতা থাকতে হয়।

“সবারই যখন পার্লামেন্টের প্রতি অ্যাকাউন্টেবিলিটি আছে এবং থ্রু দ্য পার্লামেন্ট টু পিপল অব বাংলাদেশ, বিচারপতিদের সেটা না হওয়ার তো কোনো কারণ ছিল না? সংবিধানের মূল ৯৬ অনুচ্ছেদে সেটাই ছিল। যখন অরিজিনাল ৯৬ কে ষোড়শ সংশোধনীতে নিয়ে আসা হল, সেটাকে ঘোষণা করা হল অবৈধ। তাহলে পিপলের কাছে অ্যাকাউন্টেবিলিটি রইল কোথায়? ”