জলে ডোবা চট্টগ্রাম উদ্ধারে ত্রিমুখী লড়াই

চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) একই ধরনের কাজের জন্য তিনটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে।

জাফর আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 August 2017, 05:33 AM
Updated : 3 August 2017, 05:44 AM

এর মধ্যে সিডিএ-এর প্রকল্পটি প্রাক মূল্যায়ন কমিটির অনুমোদন পেলেও সিটি করপোরেশন তাতে আপত্তি জানিয়ে বলেছে, দুই প্রস্তাবের কাজে দ্বৈততা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

একই ধরনের কাজের কথা আছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাবেও। তাদের ভাষ্য, সবার সঙ্গে কথা বলেই তারা প্রস্তাব তৈরি করেছে। 

জনপ্রতিনিধিরা চট্টগ্রামকে আধুনিক উন্নত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এলেও জলাবদ্ধতার সঙ্কটই তারা দূর করতে পারছেন না। প্রতিবছর বর্ষায় বন্দরনগরী চট্টগ্রাম বার বার সংবাদ শিরোনামে আসছে জলাবদ্ধতার যন্ত্রণা আর জনদুর্ভোগের খবর নিয়ে।

আশি লাখ মানুষের এ শহরে পানি ও বর্জ্য নিষ্কাশন হয় চাকতাইসহ অর্ধশতাধিক খাল দিয়ে। কিন্তু অবৈধ দখল, ভরাট আর বর্জ্যে বোঝাই এসব খাল ভারি বৃষ্টি হলেই আর পানি সরাতে পারে না; সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।

চলতি বছর পরিস্থিতি এতটাই খারাপ আকার ধারণ করেছে যে, ভারি বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রাম নগরীর অর্ধেক এলাকায় পানি জমে যাচ্ছে। জোয়ারের সময় পানি নামতে দেরি হওয়ায় বাড়ছে ভোগান্তি। কেবল জুলাই মাসেই অন্তত পাঁচ দফা এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বন্দরনগরীতে। আগ্রাবাদে চট্টগ্রাম কর অঞ্চল-৪ এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নৌকা কিনেছেন।

জলাবদ্ধতা নিরসনে গত ১৪ বছরে চট্টগ্রামে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ৩০৪ কোটি টাকা খরচ হলেও কার্যত তা পানিতেই গেছে। ১৯৯৩ সালে ২২ বছর মেয়াদী একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হলেও মেয়ররা যার যার মত কাজ করে যাওয়ায় সেই মাস্টারপ্ল্যান কোনো কাজে আসেনি।  

# দফায় দফায় জলাবদ্ধতায় পরিস্থিতি নাজুক হয়ে ওঠায় সিডিএ পাঁচ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ের ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুন-খনন সম্প্রসারণ সংস্কার ও উন্নয়ন’ শিরোনামে একটি প্র্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে।

# প্রায় একই কাজের জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন “চিটাগং ফ্লাড কন্ট্রোল ওয়াটার লগিং ম্যানেজমেন্ট’ শীর্ষক যে প্রকল্প প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় হাজার ৬০৩ কোটি টাকা।

# আর প্রায় দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ জলমগ্নতা/জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ শীর্ষক আরেকটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে এসেছে, যা দেওয়া হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে।

তিন প্রস্তাবেই মহানগরীর ৩৬টি খাল পুনঃখনন করে জলাবদ্ধতা নিরসনের কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, প্রতিরোধ দেয়াল, স্লুইসগেট নির্মাণের কথা এসেছে।

এর মধ্যে সিডিএ-এর প্রকল্পটি নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে গত ১৬ জুলাই প্রাক মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়। ওই সভার অনুমোদন পাওয়ার পর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হয়।

কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা সিডিএ-এর প্রস্তাব নিয়ে আপত্তি জানিয়ে গত ৬ জুলাই পরিকল্পনা কমিশনে একটি চিঠি পাঠান।

সেখানে বলা হয়, মহানগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার কাজটি সিটি করপোরেশনের, যা তারা শুরু থেকেই করে আসছে।

“এর ধারবাহিকতায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নগরীর ৩৬টি খালের মাটি উত্তোলন ও অপসারণ কাজের জন্য ১৮ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। তাছাড়া জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মহেশখাল, সুরভীখাল, ডাইভারশান খাল সংলগ্ন রাস্তা ও প্রতিরোধ দেয়ালের কাজ চলমান রয়েছে। ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে আটটি ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে।”

এছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নিজস্ব সরঞ্জাম দিয়ে খালগুলো থেকে নিয়মিত মাটি অপসারণের কাজ করার কথা জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, “এ অবস্থায় সিডিএ-এর প্রস্তাবিত প্রকল্পের সঙ্গে এসব কাজের দ্বৈততা হওয়ার সুযোগ রয়েছে।”

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে চীনা প্রতিষ্ঠান ‘পাওয়ার চায়না’র অর্থায়নে ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় ২৭টি স্লুইস গেইট, বড় খালগুলোর দুপাশে প্রতিরোধ দেওয়াল, রাস্তা ও ব্রিজ নির্মাণ এবং খাল খননের আরেকটি প্রকল্পের কথাও সিটি করপোরশেনের চিঠিতে জানানো হয়েছে। চীনা প্রতিষ্ঠানটির ওই অর্থায়ন প্রস্তাব বর্তমানে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সিডিএ-এর প্রস্তাবের বিরোধিতা করছি না। সিডিএ-এর প্রস্তাবিত প্রকল্পের অনেকগুলো কাজের সঙ্গে আমাদের চলমান কাজ ও প্রস্তাবিত প্রকল্পের সঙ্গে দ্বৈততা হতে পারে। দ্বৈততা পরিহারের জন্যই আমরা পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি দিয়েছি।”

সিটি করপোরেশনের আপত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অন্য সংস্থার কোনো প্রকল্পের কাজের সঙ্গে প্রস্তাবিত প্রকল্পের দ্বৈততা হওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের প্রকল্প চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে দ্বৈততা পরিহারের জন্য কমিটি গঠন করা হবে।”

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সিটি করপোরেশন ও সিডিএসহ আরও বেশ কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে কথা বলেই তারা ‘বাস্তবসম্মতভাবে’ ওই প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করেছেন।

“আমাদের প্রকল্পের আওতায় কর্ণফুলী নদীর ডান তীরে প্রতিরোধ দেয়ালের মাধ্যমে জোয়ারের পানি বা বন্যা থেকে চট্টগ্রাম শহরকে রক্ষা করা হবে। স্লুইসগেট নির্মাণের মাধ্যমে শহর এলাকায় লোনা পানির প্রবেশ রোধ করা হবে।”

তিনি জানান, এ প্রকল্পের আওতায় দুই দশমিক ৭০ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হবে, ৪০টি রেগুলেটর (১০টি পাম্প হাউজসহ) নির্মাণ করা করা হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হবে ২৭ কিলোমিটার। খাল  পুনঃখনন করা হবে ২৫০ কিলোমিটার (৮২ লাখ ঘন মিটার)। এসব কাজে ছয় হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে।

তিন প্রস্তাবের পথ ধরে সরকার তাহলে কোন পথে যাচ্ছে?

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সিডিএ-এর ওই প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ থাকায় অগ্রাধিকার দিয়ে তা পিইসি সভায় অনুমোদন করা হয়েছে।

“তবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আপত্তিও আমাদের হাতে এসেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডও আলাদা প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছে। তিন সংস্থার প্রস্তাবে কোনো জায়গায় দ্বৈততা হচ্ছে কি না- তা যাচাই বাচাই করেই চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হবে।”

ভৌত অবকাঠামো বিভাগের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম শহরকে কেন্দ্র করে মোট ৫৭টি খাল রয়েছে। সিডিএ-এর প্রস্তাব অনুযায়ী তাদের ৩৬টি খাল খননের দায়িত্ব দিয়ে বাকি ২১টি খাল খননের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের প্রকল্পে দেওয়া যেতে পারে। তাতে দ্বৈততা হবে না