বিচারকদের চাকরিবিধি: সরকারের খসড়া গ্রহণ করেনি আপিল বিভাগ

নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালার যে খসড়া চূড়ান্ত করে সরকার সুপ্রিম কোর্টে জমা দিয়েছে, তা গ্রহণ করেনি সর্বোচ্চ আদালত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 July 2017, 04:15 AM
Updated : 30 July 2017, 12:32 PM

ওই খসড়ার কয়েকটি শব্দ ও বিধি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা রোববার বলেছেন, আদালত যেসব সুপারিশ করেছিল, খসড়ায় এসেছে তার উল্টোটা।

“আইনমন্ত্রী আমার সঙ্গে সাক্ষাতের পর পুরোপুরি ইউটার্ন করেছেন।”

ওই চাকরিবিধির গেজেট জারি নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে টানাপড়েনের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বৃহস্পতিবার বিকালে সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে চূড়ান্ত খসড়াটি হস্তান্তর করেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের আবেদনে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত সপ্তাহে ওই গেজেট প্রকাশের জন্য ৩০ জুলাই পর্যন্ত সময় দিয়েছিল। সে অনুযায়ী রোববার বিষয়টি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারকের আপিল বেঞ্চে আসে।

কিন্তু খসড়া গ্রহণ না করে প্রধান বিচারপতি মতপার্থক্য নিরসনে বৈঠকে বসার কথা বলেন। 

অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “আমরা চাই সুন্দর একটা আইন হোক। তাই আসুন আমরা বসি। আমি এবং আপিল বিভাগের আমরা সব বিচারক, আপনি, মাননীয় আইন মন্ত্রী ও আইন মন্ত্রণালয় চাইলে তাদের পক্ষ থেকে এক্সপার্ট যে কয়জন ইচ্ছা সে মিটিংয়ে রাখতে পারবে। আজ থেকে বৃহস্পতিবার যে কোনো দিন দুপুর ২টার পর থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত আমাদের বসতে সমস্যা নেই।”

এরপর আগামী রোববার বিষয়টি আদেশের জন্য রাখে আদালত।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (ফাইল ছবি)

‘তাহলে হাই কোর্ট কেন রাখবেন?’

শুনানির শুরুতেই আইনমন্ত্রীর দেওয়া খসড়ায় ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’ শব্দ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি।

তিনি বলেন, “আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হল। উনি খসড়া দিয়ে গেলেন। আমি তো খুশি হয়ে গেলাম। যদিও খুলে দেখিনি। কিন্তু এটা কী! এখানে বলা হল ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’। এটার মানে কী? সব আইনে ব্যাখ্যা থাকে। কিন্তু এখানে কোনো ব্যাখ্যা নেই। কর্তৃপক্ষ বলতে বিচার বিভাগের জন্য রাষ্ট্রপতিকে রাখলেন। তবে তো আইন মন্ত্রণালয়ই থাকছে। এর সমাধান না হলে চলবে না।”

ওই খসড়া থেকে উদ্ধৃত করে প্রধান বিচারপতি বলেন, “সরকার কর্তৃক নির্ধারিত তারিখ থেকে গেজেট কার্যকর হবে বলা আছে। অথচ মাসদার হোসেন মামলায় নির্দেশনা আছে, সুপ্রিম কোর্ট যে তারিখ থেকে কার্যকরের পরামর্শ দেবেন, সেই তারিখ থেকে কার্যকর হবে। আমরা যেটা পাঠিয়েছি তার উল্টোটা পাঠিয়েছেন। রায়ের ষোলো বছরে হয়নি। আর এভাবে হলে ষোলো শ বছরেও গেজেট হবে না।”

প্রধান বিচারপতি বলেন, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাকে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে আইনমন্ত্রীর দেওয়া বিধিমালার খসড়ায়।

“তাহলে হাই কোর্টের কী থাকল? সবই তো মন্ত্রণালয়ের। ১৮৬১ সালে কলকাতা হাই কোর্ট হয়েছে; তখন থেকে হাই কোর্টের বিচারকরা নিম্ন আদালত পরিদর্শন করেন। এ ব্যবস্থাই চলে আসছে। হাই কোর্ট কেন রাখবেন? হাই কোর্ট উঠিয়ে দিন।”

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম মাননীয় আইনমন্ত্রী এসেছেন। এসে খসড়া দিয়ে গেছেন। প্রেসে বক্তব্য দিয়েছেন যে বিধিমালা হয়ে গেছে। কিন্তু এ কী রকম হল!”

এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আমি বিদেশে যাওয়ার সময় মন্ত্রণালয় জিও দেয়।”

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, “আপনি তাহলে অ্যাভয়েড করছেন?”

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “না।”

প্রধান বিচারপতি বলেন, “খসড়ার বিষয়ে আইনমন্ত্রীর সাথে আমার যে আলাপ হয়েছিল, আমি যে বিষয়গুলো খসড়ায় রাখার কথা বলেছিলাম, হি ওয়াজ টোটালি স্যাটিসফায়েড। বাট তিনি সেদিন যে খসড়া দিলেন সেখানে ‘কম্পিটলি ইউটার্ন’।

এই মতপার্থক্য দূর করে বিধিমালা চূড়ান্ত করার জন্য বৃহস্পতিবারের মধ্যে যে কোনো দিন বৈঠকে বসার তাগিদ দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন,  “আপিল বিভাগের বিচারপতিরা রাত ১২টা পর্যন্ত আপনাদের সময় দেব। বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালা নিয়ে আর রশি টানাটানি নয়। আইনমন্ত্রীসহ সরকারের যে কোনো এক্সপার্ট আসবেন, বৈঠকে বসব।”

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক

‘আমি তো কোনো ভূমিকা রাখতে পারি না’

শুনানির পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “বিধিমালার খসড়ার কয়েকটি ধারার বিষয়ে প্রধান বিচারপতি আজ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আমাকে বলেছেন, আইনমন্ত্রীর সাথে এবং আইন মন্ত্রণালয় যদি অন্য কোনো কর্মকর্তা পাঠাতে চায় তাদের সাথে বসতে চান আপিল বিভাগের বিচারপতিরা… এ ব্যাপারটা সুরাহা করার জন্য। এ ব্যাপারে আমি আইন মন্ত্রণালয়কে জানাব।”

কোন কোন বিষয়ে আপিল বিভাগের দ্বিমত রয়েছে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সেগুলো অল্প সময়ে মিডিয়ার সামনে বিস্তারিত বলা সম্ভব না। 

বিধিমালায় ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের’ উল্লেখ নিয়ে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মাহবুবে আলম বলেন, “প্রধান বিচারপতি বলতে চান, অন্যান্য ডিপার্টমেন্টে যখন কোনো প্রসিডিংস শুরু হয়, সেই ডিপার্টমেন্টের প্রধানরাই তা শুরু করেন। কিন্তু উনাদের মতে, এখানে (বিধিমালায়) সেই ক্ষমতা আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে রেখে দেওয়া হয়েছে।” 
 
নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, “আইন মন্ত্রণালয় আমাকে যা দেয়, তা আমি আদালতের কাছে পেশ করি। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় তো সরাসরি আমাকে (বিধিমালা) দেয়নি, দিয়েছে প্রধান বিচারপতির কাছে। সেটা দিয়েছে পর্যালোচনার জন্য। এখন আদালতের যে পর্যালোচনা সেটি আমি আইন মন্ত্রণালয়কে জানাব।” 

কোনো আইন করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের দ্বিমত হলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই তার নিষ্পত্তি করা সম্ভব বলেও মত প্রকাশ করেন রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কর্মকর্তা।  

রাষ্ট্রের দুই স্তম্ভের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে গিয়ে এই টানাপড়েনে অসহায়ত্ব বোধ করছেন কি না- এমন প্রশ্নে মাহবুবে আলম বলেন, “এটা অসহায়ত্বের বিষয় না। অন্যান্য দেশে অ্যাটর্নি জেনারেল আইন মন্ত্রীর মর্যাদায় থাকে; যেমন যুক্তরাষ্ট্রে নীতিগত সিদ্ধান্ত অ্যাটর্নি জেনারেলই নেন। কিন্তু আমাদের দেশে নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো নেয় মন্ত্রণালয়। সুতরাং মন্ত্রণালয়ের বাইরে গিয়ে তো কোনো কথা আমি বলতে পারি না। আমি কোনো রকম ভূমিকা রাখতে পারি না।” 

ঘটনাক্রম

মাসদার হোসেন মামলার চূড়ান্ত শুনানি করে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করতে ঐতিহাসিক রায় দেয়।

ওই রায়ে আপিল বিভাগ বিসিএস (বিচার) ক্যাডারকে সংবিধান পরিপন্থি ও বাতিল ঘোষণা করে। একইসঙ্গে জুডিশিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র সার্ভিস ঘোষণা করা হয়। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার জন্য সরকারকে ১২ দফা নির্দেশনা দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়।

আপিল বিভাগের নির্দেশনায় গত বছরের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়।

সরকারের খসড়াটি ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার অনুরূপ হওয়ায় তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থি বলে জানায় আপিল বিভাগ।

এরপর ওই খসড়া সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্ট আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেইসঙ্গে তা চূড়ান্ত করে প্রতিবেদন আকারে আদালতে উপস্থাপন করতে বলা হয় আইন মন্ত্রণালয়কে।

এরপর দফায় দফায় সময় দেওয়া হলেও সরকার ওই বিধিমালার গেজেট প্রকাশ না করায় গত ৮ ডিসেম্বর দুই সচিবকে তলব করে আপিল বিভাগ।

দুই সচিবের হাজিরার আগে ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে একটি নোটিসে বলা হয়, নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ সংক্রান্ত বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে রাষ্ট্রপতি ‘সিদ্ধান্ত’ দিয়েছেন।

আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক পরদিন আদালতের তলবে হাজির হলে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিধিমালা নিয়ে ‘রাষ্ট্রপতিকে ভুল বোঝানো হয়েছে’।

সেদিন শুনানি করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মাধ্যমে সরকারকে নির্দেশ দেয় আপিল বিভাগ। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বারবার সময় নেওয়া হচ্ছিল।

এর মধ্যে জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেন আইনমন্ত্রী। তখন তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আলোচনায় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে এবং সরকার শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।