আদালতে ‘অযোগ্য’ ঘোষিত নওয়াজ শরিফের পদত্যাগ

পানামা পেপার্স মামলায় ‘পদে থাকার অযোগ্য’ ঘোষিত হওয়ার পর সরে দাঁড়িয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 July 2017, 08:54 AM
Updated : 28 July 2017, 04:49 PM

দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের পর সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ শুক্রবার সর্বসম্মত এক রায়ে নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার অযোগ্য ঘোষণা করে।

নওয়াজ শরিফ বরাবরই দুর্নীতির এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসেছিলেন। তবে আদালতের আদেশের পরপরই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এক বিবৃতিতে নওয়াজ শরিফের পদত্যাগের কথা জানায়।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারকেও দায়িত্বে থাকার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে।

নওয়াজ পরিবারের সাবেক হিসাব রক্ষক ইসহাক ছিলেন পাকিস্তানের মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য। আদালতের নির্দেশে তিনিই নওয়াজের পরিবারের সম্পদের তথ্য ও নথি আদালতে উপস্থাপন করেছিলেন।

এই রায়ের ফলে তৃতীয় মেয়াদেও পুরো সময় ক্ষমতায় থাকা হল না পাকিস্তান মুসলিম লীগের (পিএমএল-এন) নেতা নওয়াজ শরীফের। প্রায় এক বছর বাকি থাকতেই তাকে দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে সরে যেতে হল।

এ অবস্থায় ২০১৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত সরকার চালিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে নওয়াজের ভাই পাঞ্জাব প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের নাম জোরালোভাবে আলোচনায় রয়েছে বলে পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যমের খবর।

নিয়ম অনুযায়ী, ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লিগ (নওয়াজ) এখন স্পিকারের অনুমতি নিয়ে নতুন একজনকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করতে পারবে। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত তিনিই সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পাবেন। 

রায়ের পর নওয়াজ সমর্থকদের বিলাপ

বিবিসি লিখেছে, নওয়াজ শরীফের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে আবারও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল। তার আগের ১৭ জন প্রধানমন্ত্রীর কেউই তাদের পুরো মেয়াদ কখনও দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। 

পাকিস্তানের অনেকেই মনে করছেন, নওয়াজ শরিফকে দিয়েই দুর্নীতির চক্র ভাঙার কাজ শুরু করল দেশটির উচ্চ আদালত।

আবার কারও কারও ধারণা, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যে প্রক্রিয়ায় যুগের পর যুগ বেসামরিক প্রশাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে, এটা তারই একটি অংশ। দুর্নীতির চক্র ভাঙার বদলে এই রায় আসলে একদল নতুন লোকের রাজনৈতিক উচ্চাশা পূরণের পথ খুললো, যেমনটা অতীতেও হয়েছে।

এই রায় ঘিরে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় আদালত এলাকাসহ পুরো রাজধানীতে হাজার হাজার সেনা ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বিচারক যখন রায় ঘোষণা করেন, তখন আদালতকক্ষে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। 

বিচারপতি এজাজ আফজাল খান রায়ে বলেন, তদন্তে পাওয়া তথ্য প্রমাণ থেকে তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, একজন সৎ পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার যোগ্যতা  নওয়াজ শরিফের আর নেই।

নওয়াজ শরীফ, তার মেয়ে মরিয়ম, জামাতা সফদর, অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির নিয়মিত মামলা দায়ের করতে বলা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে।

নওয়াজ শরীফের মেয়ে মরিয়ম

পানামা পেপার্সের পর

গত বছর ফাঁস হওয়া পানামা পেপারসে নওয়াজ শরীফের মেয়ে মরিয়ম ও ছেলে হাসান-হুসেনের নাম আসে। তারা তিনজন ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত বিভিন্ন অফশোর কোম্পানির নামে লন্ডনে সম্পত্তি কিনেছেন বলে সেখানে তথ্য পাওয়া যায়, যার উল্লেখ তাদের ঘোষিত সম্পদ বিবরণীতে ছিল না।

পানামা পেপারস আলোড়ন তোলার পর বিরোধী দলগুলো নওয়াজ পরিবারের সম্পত্তির হিসাব ও দুর্নীতির তদন্ত করতে সুপ্রিম কোর্টের কাছে দাবি জানায়।

গত জুনে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট জানায়, পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারিতে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে অপসারণ করার মত পর্যাপ্ত প্রমাণ মেলেনি। তবে নওয়াজ পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে সে সময় একটি যৌথ দল গঠনের নির্দেশ দেয় আদালত।

সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা সদস্যদের নিয়ে গঠিত ছয় সদস্যের এ তদন্ত দলকে নওয়াজ পরিবারের তিন পুরুষের সম্পত্তির হিসাব নিতে বলা হয়; একইসঙ্গে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

নওয়াজ শরীফ ও তার সন্তানরা শুরু থেকেই তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। পরিবারের সব সম্পত্তিই বৈধ উপায়ে কেনা বলেও তাদের দাবি। যৌথ তদন্ত দলের (জেআইটি) জিজ্ঞাসাবাদেরও প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ও তার সন্তানরা একই কথা বলেন।

রায় ঘিরে নিরাপত্তা

সেলুনেও নজর টেলিভিশনে রায়ের খবরে

নওয়াজের বাবা ছিলেন দেশটির একজন খ্যাতিমান শিল্পপতি। তাকে ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে সেই আশির দশক থেকেই। আর পানামা পেপার্সে যেসব সম্পদের তথ্য এসেছে, সেসব নিয়ে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়েই পাকিস্তানে তদন্ত শুরু হয়েছিল। 

এর আগে ১৯৯০ ও ১৯৯৭ সালে দুই বার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেও ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় কোনোবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি নওয়াজ।

দ্বিতীয়বার সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তিনি দেশান্তরিত হয়েছিলেন। তখন বেশিরভাগ সময় তিনি থাকতেন সৌদি আরবে। ২০১৩ সালের নির্বাচনে ফের ক্ষমতায় আসেন তিনি।

তবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফই পানামা পেপার্সের প্রথম শিকার নন। এর আগে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীও পদত্যাগের বাধ্য হয়েছিলেন পানামা পেপার্সে নাম আসার কারণে।

নওয়াজ শরিফের উত্থান পতন

>> পাকিস্তান মুসলিম লীগ-এনের (পিএমএল-এন) প্রেসিডেন্ট নওয়াজ দেশটির অন্যতম শীর্ষ সম্পদশালী শিল্পপতি; স্টিল শিল্পগোষ্ঠী ইত্তেফাক গ্রুপের মালিক।

>> পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হকের অনুসারী নওয়াজ পাকিস্তানের বাইরে ১৯৯৮ সালে দেশের প্রথম পরমাণু পরীক্ষার আদেশের জন্যই বেশি পরিচিত।

>>১৯৪৯ সালে লাহোরের এক ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম নেওয়া নওয়াজ শরিফ জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে উঠে আসেন জেনারেল জিয়ার সেনা শাসনের প্রথম দিকে। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে পাঞ্জাবের অর্থমন্ত্রী ও পরে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি।

>> ৬৭ বছর বয়সী নওয়াজ শরিফ তিন দশক ধরে পাকিস্তানের অন্যতম শীর্ষ রাজনীতিবিদ। তৃতীয় দফায় জেতার আগে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ এবং ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত দুই বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

>> ১৯৯০ সালে প্রথমবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার তিন বছরের মাথায় নওয়াজ পদচ্যুত হন; তাতে বিরোধী দলীয় নেতা বেনজির ভুট্টোর সরকার গঠনের পথ পরিষ্কার হয়।

>> ১৯৯৭ সালে আবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়ে নওয়াজ শরিফ রাজনীতি ও  সেনাবাহিনী বাদে দেশের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট ও দেশের ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।

>> ১৯৯৯ সালে সেনা প্রধান পারভেজ মুশাররফ নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। তাকে গ্রেপ্তারের পর ছিনতাই ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়; দুর্নীতির দায়ে আজীবন রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধও করা হয়। তবে সৌদি আরবের সঙ্গে কথিত সমঝোতার আওতায় কারাদণ্ড থেকে বেঁচে গিয়ে নওয়াজ শরিফ পরিবারের ৪০ সদস্যসহ ১০ বছরের নির্বাসনে যান।

>> ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন নওয়াজ; ধৈর্য ধরে বিরোধী দলে থাকেন। পরের বছর নির্বাচনে তার দল সংসদে চার ভাগের একভাগ আসনে জয়ী হয়।

 

>> ২০১৩ সালে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তৃতীয়বারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইতিহাস সৃষ্টি করেন নওয়াজ শরিফ। সেটাই ছিল স্বাধীনতার পর পাকিস্তানে প্রথম গণতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তর।

>> তৃতীয় দফায় ক্ষমতা নিয়ে দুর্নীতি দমন ও নতুন অবকাঠামোর নির্মাণের মাধ্যমে পাকিস্তানকে ‘এশিয়ার বাঘে’ পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দেন নওয়াজ শরিফ। কিন্তু সমস্যা বাড়তে থাকে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে চীনের ৫৬ বিলিয়ন ডলারের   অর্থায়নে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর ছাড়া আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ অর্জন দেখা যায়নি।

>> ক্ষমতায় বসেই নিজের এলাকা পাঞ্জাব প্রদেশে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের দলের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় নওয়াজকে; নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে তুলে ইসলামাবাদে ছয় মাসের অবরোধ ডাকে ইমরানের দল পিটিআই। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক সম্প্রসারণের উদ্যোগ থেকে বিরত রাখতে চাপপ্রয়োগের জন্য সামরিক বাহিনীর মদদে ওই অবরোধ ডাকা হয় বলে অনেকের অভিযোগ রয়েছে।

>> গত বছর পানামা পেপার্স ফাঁস হলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নতুন হুমকির মুখে পড়েন; সেন্ট্রাল লন্ডনে তার পরিবারের মালিকানায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট থাকার অভিযোগ উঠে। তার অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। নজিরবিহীনভাবে সুপ্রিম কোর্ট এই অভিযোগের তদন্তের দায়িত্ব নেয়। নওয়াজ শরিফ কোনো অপরাধ করেননি জানিয়ে ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকার করেন।

>> শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে ‘দায়িত্ব পালনের অযোগ্য’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নওয়াজ শরিফের তৃতীয় মেয়াদেরও পরিসমাপ্তি ঘটল নির্ধারিত সময়ের আগে।