সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হতে চান ইসি কর্মকর্তারা

ভোট আয়োজনে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব রাখতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের মাঠ কর্মকর্তারা রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পেতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সংস্কারের প্রস্তাব করেছেন।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 July 2017, 03:11 AM
Updated : 25 July 2017, 03:13 AM

সেই সঙ্গে আমলাদের অবসরের পর ভোটে আসার বিধিনিষেধ পাঁচ বছর করা, সশস্ত্রবাহিনীকে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সংজ্ঞায় আনা, রিটার্নিং অফিসারকে প্রার্থিতা বাতিল এবং আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে হাকিমদের মতো ক্ষমতা দেওয়া, প্রার্থীদের জামানতের টাকা বাড়ানো, কোনো প্রার্থী নিজেকে ‘স্বশিক্ষিত’ বলে দাবি করলেও সেজন্য সনদ নেওয়ার বিধান চালু এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে তদারকিতে আনতে নির্বাচনী আইন সংস্কারের সুপারিশ করেছেন ইসি কর্মকর্তারা।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) অন্তত ৩৫টি অনুচ্ছেদে সংস্কার আনার প্রস্তাব এসেছে এই মাঠ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। তাদের এসব প্রস্তাব একীভূত করে রোববার নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে।

একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আরপিও এবং নির্বাচন পরিচালনা বিধি, রাজনৈতিক দল নিবন্ধনবিধি, আচরণবিধিসহ সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী আইন সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে ইসি। এ লক্ষ্যে ৩১ জুলাই থেকে শুরু হচ্ছে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে সংলাপ ।

ইসির আইন সংস্কার সংক্রান্ত এই কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম। এ বিষয়ে মাঠ কর্মকর্তাদের ভাষ্য জানতে সংলাপের আগে ১০ আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছ থেকে মতামত সংগ্রহ করে কমিটি।

কবিতা খানম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাঠপর্যায়ের মতামতগুলো আমরা নিয়েছি। কারণ যারা এগুলো ফেইস করেন, তারাই বলতে পারবেন- কোন কোন জায়গায় সংস্কার করা দরকার। যেসব প্রস্তাব যুক্তিসঙ্গত মনে হবে, নির্বাচন প্রক্রিয়াকে যা সহজ করবে, যুগোপযোগী করবে, শুধুমাত্র সেই বিষয়গুলোকে আমরা বাছাই করব।”

রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের সংলাপে বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে জানিয়ে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, “তারপর আমরা খসড় চূড়ান্ত করব, আইন সংশোধনের জন্য প্রস্তাব দেব।”

ইসি কর্মকর্তারা জানান, মাঠ কর্মকর্তারা যেসব প্রস্তাব দিয়েছেন তার মধ্যে পুরনো অনেক বিষয় রয়েছে। গত কমিশন বিদায়ের আগে কিছু প্রস্তাব দিয়েছিল, সেসবও বর্তমান ইসির সামনে উপস্থাপন করা হবে। আরপিওর পাশাপাশি অন্যান্য বিধির সুপারিশগুলো পর্যায়ক্রমে ইসির নজরে আনা হবে।

যেসব সংস্কার চান ইসি কর্মকর্তারা

আরপিওর অনুচ্ছেদ-২ এ আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব এসেছে । এর পক্ষে তাদের যুক্তি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগ যুক্ত হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ইসির ‘নিরপেক্ষতা দৃশ্যমান’ হবে।

স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও ব্যক্তিগত ব্যয়ের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা প্রয়োজন বলে মত এসেছে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে।

স্বশিক্ষিত-এর নতুন সংজ্ঞায়নের প্রস্তাবের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামায় সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সার্টিফিকেটের সত্যায়িত কপি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু অনেক প্রার্থী স্বশিক্ষিত উল্লেখ করে কোনো সনদের কপি দেন না। বিষয়টি স্পষ্ট করা প্রয়োজন।

আইন--শৃঙ্খলা রক্ষায় নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম নিয়োজিত থাকেন ভোটের সময়ে। ইসির সরাসরি নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্থে আইন সেলের মাধ্যমে ‘ইলেকটোরাল ম্যাজিস্ট্রেট’ নাম দিয়ে তাদের নিয়োগ করা যায়। এতে ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে দায়িত্ব দেওয়া যাবে।

অনুচ্ছেদ ৭ এ ইসি কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোন কর্মকর্তাকে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করা হবে তা এখন আইনে উল্লেখ নেই। সরকারি কর্মকর্তা বা ইসির কর্মকর্তাদেরকে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের জন্য বিষয়টি আইনে যুক্ত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকার জন্য ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাকে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করা যায় এবং কোনো ব্যক্তিকে দুই তা ততোধিক এলাকার দায়িত্বও দেওয়া যায়। সেই সঙ্গে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান করা যেতে পারে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। সেই সঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে কয়েকটি এলাকায় জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন অফিসার ও উপজেলা নির্বাচন অফিসারকেও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়ার নজির রয়েছে।

সংসদ নির্বাচনে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার থাকলেও সংসদের উপ নির্বাচনে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের এ দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।

১২ অনুচ্ছেদে সরকারি আমলাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত, অপসারণ, অবসর বা পদতাগের পর তিন বছরের মধ্যে ভোটে অংশ নেওয়ার যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা বাড়িয়ে পাঁচ বছর করার প্রস্তাব রয়েছে। ইসি কর্মকর্তাদের যুক্তি,  এতে রাজনৈতিক সরকারের  অধীনে চাকরিরত আমলাদের ‘রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস’ থেকে মুক্ত রাখা যাবে।

বর্তমানে ঋণখেলাপী-বিলখেলাপীরা অর্থ পরিশোধের জন্য মনোনয়নপত্র জমার সাত দিন আগে পর্যন্ত সময় পান। তা মনোনয়ন দাখিলের দিন পর্যন্ত করার প্রস্তাব এসেছে।

স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনসূচক তালিকা দেওয়ার যে বিধান রয়েছে, তা বাতিলেরও সুপারিশ রয়েছে।  এর পক্ষে কর্মকর্তাদের যুক্তি- যারা স্বাক্ষর দেন তাদের অনেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন; ভয়ে সমর্থনসূচক স্বাক্ষরের বিষয়টি অস্বীকার করেন। আবার অনেক ভোটার অর্থ লেনদেনে জড়িয়ে পড়েন।

মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট দেওয়ার কথা রয়েছে। তা না থাকলে মার্কশিট বা প্রশংসাপত্র দেওয়ার বিধান রাখার পক্ষে মত এসেছে।

১৩ অনুচ্ছেদে প্রার্থীদের জামানত ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।

১৪ অনুচ্ছেদে মনোনয়ন দাখিল থেকে ভোট পর্যন্ত কেউ অসত্য তথ্য দিলে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা রিটার্নিং অফিসারকে দেওয়ার সুপারিশ এসেছে।

২৭ অনুচ্ছেদে পোস্টাল ব্যালটের বিধান বাতিলের সুপারিশ করেছেন মাঠের কর্মকর্তারা। তাদের যুক্তি, এ বিধানটির কার্যকারিতা নেই বললেই চলে।

৩৮ অনুচ্ছেদে সমভোট প্রাপ্তদের মধ্যে বিজয়ী ঘোষণার জন্য লটারি প্রথা বাতিল করে পুনঃভোট আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছেন কর্মকর্তারা। তাদের যুক্তি ওই বিধান ‘সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’।

৪১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বর্তমানে কাস্টিং ভোটের এক অষ্টমাংশ না পেলে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। তা বাড়িয়ে এক পঞ্চমাংশ করার প্রস্তাব এসেছে।

প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলের ব্যয় তদারকিতে রিটার্নিং অফিসারের অধীনে একটি মনিটরিং কমিটি করা এবং অডিটে অপরাধ প্রমাণিত হলে পদ শূন্য ঘোষণার বিধান রাখার কথাও মাঠ কর্মকর্তারা বলেছেন।

রাজনৈতিক দল নির্ধারিত সময়ে ব্যয় বিবরণী দিতে ব্যর্থ হলে জরিমানা ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

আচরণবিধি নিয়ন্ত্রণে হাকিমদের পাশাপাশি ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দলের অনিয়ম ধরতে ‘তৃতীয় চোখ’ হিসেবে বিশেষ মনিটরিং টিম রাখার সুপারিশ এসেছে।

নির্বাচনকালীন যানবাহন সংগ্রহের সুবিধার্থে ‘হুকুম দখলের’ ব্যপ্তি বাড়ানো,  জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তিন মাস আগে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রিজাইডিং কর্মকর্তার প্যানেল তৈরি, মনোনয়নপত্র জমা শেষ তারিখের কমপক্ষে একদিন পর বাছাইয়ের জন্য একাধিক তারিখ রাখা,  টিআইএন সনদ দাখিলে ১২ ডিজিট ব্যবহার, মনোনয়নপত্র বাতিল বা গ্রহণে বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ থাকলেও বৈধ ঘোষিত বিষয়ে রিটার্নিং অফিসারের ক্ষমতা বাড়ানো, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণার বিষয়টি স্পষ্ট করা, ভোটের দিন বিভিন্ন ঘটনায় কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করতে প্রিজাইডিং কর্মকর্তার ক্ষমতার পাশাপাশি ভোটের আগে রাতে ব্যালট ছিনতাই-পরিস্থিতির অবনতি হলে  কেন্দ্রের ভোট বাতিলের ক্ষমতা রিটার্নিং অফিসারকে দেওয়ার মত বিষয়ে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে সংযোজন-বিয়োজন চাওয়া হয়েছে মাঠ কর্মকর্তাদের প্রস্তাবে।