দায় আসে, অথচ মেয়রের কিছু করার থাকে না: আনিসুল

রাজধানীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে ‘বিকলাঙ্গ’ আখ্যায়িত করে বর্তমান অবস্থায় তার দায়িত্ব নিতে চাইলেন না ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 July 2017, 04:24 PM
Updated : 16 July 2017, 04:24 PM

রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার প্রধানদের নিয়ে সমন্বয় সভায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খোন্দকার মোশাররফ হোসেন মেয়রকে দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দেন।

মন্ত্রী বলেন, “জনপ্রতিনিধিরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। আমার মতে, আপনারা সবাই যদি এগ্রি করেন তাহলে ড্রেনেজের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের কাছে দিতে চাই।”

তখন মেয়র আনিসুল হক বলেন, “আগে রোগী ভালো কইরা… রোগী ভালো করার পর বাচ্চা দিয়ে দেন আমাকে। রোগীর ক্যান্সার, সেই রোগী নিয়ে আমি কী করব?”

জবাবে মন্ত্রী বলেন, “আগে রোগী গ্রহণ করেন, ভালো করার দায়িত্ব আমার।”

এই সভায় স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ঢাকার বিভিন্ন সেবা সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের বিষয়টি তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, পৃথিবীতে ঢাকাই একমাত্র রাজধানী যেখানে ৫৪টি সংস্থা কাজ করে। সরকারি সংস্থার প্রধানরা অস্থায়ী কিন্তু মেয়র ৫ বছরের জন্য থাকেন, এ কারণে রাজধানীর বাসিন্দারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মেয়রকে দায়ী করেন।

“চেয়ারম্যানকে তো কালকে বদলি করে দিতে পারে। তো আপনার কাছেই তো আমি যাব। তাই ধীরে ধীরে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে আপনার আওতায় নিয়ে আসেন।”

পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দেন।

“এটা করা একান্তই দরকার। খালগুলো উদ্ধারে ডিসিসি, ওয়াসা, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় একসঙ্গে বসে ঠিক করতে হবে।”

মেয়র আনিসুল হকের সভাপতিত্বে এই সভায় ঢাকা-১১ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম রহমত উল্লাহ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্থপতি এবং বিভিন্ন সেবাসংস্থার প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় ঢাকায় জলাবদ্ধতার কারণ এবং রাজধানীর খালগুলোর বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. শরীফ উদ্দিন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মিরপুরের বাউনিয়া খাল মিরপুর এলাকার পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম। তবে মাটিকাটা সড়কের কালভার্টের কাছে খাল ৭ ফুট হয়ে গেছে। ফলে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কল্যাণপুর ‘খ’ খাল কাগজে-কলমে ৪০ ফুট হলেও অনেক জায়গায় খালের কোনো অস্তিত্ব নেই।

একইভাবে উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় পড়া ওয়াসার ২৩টি খাল দখল ও আবর্জনা জমে থাকায় পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

হাতিরঝিল প্রকল্পের কারণে টিসিবি ভবনের সামনে আউটলেট বন্ধ করে দেয়ায় কারওয়ানবাজারে জলাবদ্ধতা হচ্ছে বলে। আবদুল্লাহপুরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্লুইসগেটের কারণে পানি নামতে না পেরে উত্তরা এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়েছে। স্লুইসগেট পুরোনো হওয়ায় নিকুঞ্জ-১ এবং নিকুঞ্জ-২ এলাকা থেকে বৃষ্টির পানি সরতে পারে না।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কারণে বিমানবন্দর সড়কের পাশের প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ভরাট করে ফেলায় বনানী, সেনানিবাস ও খিলক্ষেত এলাকার পানি সরতে দেরি হচ্ছে। এ কারণে সেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

প্রতিবেদন উপস্থাপন শেষে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বক্তব্য দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান মেয়র আনিসুল হক।

ঢাকা ওয়াসা বিদ্যমান যে খালগুলো পেয়েছে সেগুলোই রক্ষণাবেক্ষণ করছে বলে বৈঠকে জানান ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান।

তিনি বলেন, খালের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম নিয়মিত চলছে। তবে অনেক খালে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকায় সেগুলো অধিগ্রহণ করে খাল খনন না করলে সমস্যার সমাধান করা কঠিন।

খালগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় বলে দাবি করেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

এ সময় মেয়র বলেন, প্রতিবেদনের ছবি কিন্তু সে কথা বলছে না।

“খালগুলো কাটা এবং পরিষ্কার- আমার একটি ছবিও সেভাবে প্রতিফলিত হয় না। সে কথা বলছে না। পানি যায় না।”

৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজিবও বলেন, “একটা খালে তিন দিন তারা কাজ করে। অল্প একটু জায়গা পরিষ্কার করে, ময়লাগুলো সেখানে ফেলে চলে যায়। এজন্য আমাদের দুর্ভোগের শেষ নাই।”

ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, রাজধানীর সব কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা যাচ্ছে না।

“আনফরচুনেটলি আমরা ১০০ ভাগ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে পারছি না। বাকিটা খালে যাচ্ছে। যে কারণে আমরা যতই পরিষ্কার করে আসি না কেন, ৫-৭ দিন পরেই তা আবার ভরাট হয়ে যাচ্ছে।”

খালগুলোর মালিক জেলা প্রশাসন, আর রক্ষণাবেক্ষণ করে ঢাকা ওয়াসা।

ঢাকা জেলা প্রশাসককে উদ্দেশ করে মেয়র বলেন, “আমাদের খাল বুঝাইয়া দেন, ওয়াসা আমাদের খাল বুঝাইয়া দেন। আমি কোনো দায় নেব না। সারা দেশ আমাকে গালি দেবে, যেটার দায়িত্ব সরাসরি আমার না।”

পানি নিষ্কাশনসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্তৃত্ব সিটি করপোরেশনের কাছে দিতে বিভিন্ন সময় বলে আসছেন মেয়র আনিসুল হক।

তিনি সভায় বলেন, “আমিও বলেছি এটা নিয়ে নেব। সেখানে ১১২ জনের একটা লোকবল আছে। কিন্তু জিনিসপত্র আছে। কিন্তু আমি কী নেব? হোয়াই শ্যুড আই টেইক অ্যা লায়াবিলিটি?

“প্রত্যেকদিন কিছু হলেই সরাসরি আক্রমণটা আসে মেয়রের ওপর। সেটা চিকুনগুনিয়া হোক, জলজট হোক অথবা যানজট হোক। যেখানে মেয়রের সরাসরি কিছু করার থাকে না।”

ঢাকার পানি নিষ্কাশনে একটি মহাপরিকল্পনা এখনই করার তাগিদ দেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, খাল এবং নিম্নাঞ্চল ভরাট করে ফেলার কুফল ঢাকার মানুষ পেতে শুরু করেছে।

“এই খালগুলো ভরাট হওয়ার ফল ঢাকার মানুষ পেতে শুরু করেছে। পূর্বাচল যেটি নতুন শহর তার অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে। তার লক্ষণ ইতোমধ্যে দক্ষিণখান, উত্তরখানের মানুষ পেতে শুরু করেছে। আমরা গত ১৫ বছর ধরে আমরা চিৎকার চেঁচামেচি করেছি। তখন আপনারা কেউই বোঝেন নাই, বন্যার পানিতে ডুববেন।”

“যখন ডুবছেন তখন আবারও বলছি, ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানে থাকা নিম্নাঞ্চল এবং জলাভূমি রক্ষায় রাজউককে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।”

পানি উন্নয়নের বোর্ডের স্লুইচগেটের কারণে জলাবদ্ধতা হলে সেটা ঠিক করার আশ্বাস দেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল।

নদীর দখল করে ফেলা জায়গা উদ্ধারে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ।

সভা শেষে মেয়র বলেন, “আমরা আগামী একবছরের মধ্যে সমাধানে যেতে চাই। ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে চাই।”