চিকুনগুনিয়ার দায় কার

প্রায় এক দশক আগে বাংলাদেশে প্রথম উপস্থিতি জানান দেওয়া ভাইরাস জ্বর চিকুনগুনিয়া কেন চলতি বছর ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ল, তার দায় নিতে রাজি নয় কেউ। 

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 July 2017, 04:26 PM
Updated : 14 July 2017, 05:01 PM

মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়ার কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক নেই। এ রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ।

গত পাঁচ বছরে ঢাকা সিটি করপোরেশন মশা মারতে ১১৬ কোটি টাকা খরচ করলেও ক্ষুদ্র ওই পতঙ্গের উপদ্রব না কমায় ভুক্তভোগীরা নগর কর্তৃপক্ষের দিকে অভিযোগের অঙুল তুলেছেন। এমনকি স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও ঢাকায় চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়ার জন্য দুই সিটি করপোরেশনকেই দায়ী করেছেন।

তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অভিযোগ মানতে রাজি নন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক ও মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। তাদের ভাষ্য, কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব যখন হয়, সম্মিলিতভাবেই তা প্রতিরোধ করতে হয়।

এ রোগ নিয়ে অভিজ্ঞতা কম থাকায় প্রস্তুতির অভাবের বিষয়টি স্বীকার করেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র খোকন আগামী ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার আশার কথা শুনিয়েছেন।

অন্যদিকে উত্তরের মেয়র আনিসুল হক দাবি করেছেন, ড্রেনের মশা নয়, ঘরে জন্ম নেওয়া এডিস মশার কারণেই এ রোগ ছড়াচ্ছে, যেখানে পৌঁছানো সিটি করপোরেশনের পক্ষে সম্ভব নয়।

আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ায় ১৯৫২ সালে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটার পর তা ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে এ রোগ দেখা দেয় ২০০৮ সালে, যার প্রকোপ চলতি বছর বর্ষা মওসুমের শুরু থেকে বেশি দেখা যাচ্ছে।

ঢাকার ২৩টি এলাকাকে এ রোগের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সরকারের রোগ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইইডিসিআর।

চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তদের কেন সরকার ক্ষতিপূরণ দেবে না– তা জানতে চেয়ে হাই কোর্ট একটি রুল জারি করেছে।

চিকুনগুনিয়া বৃত্তান্ত

# তানজানিয়ার মাকোনডে ভাষায় চিকুনগুনিয়া অর্থ হল, যা বাঁকিয়ে ফেলে। শুরুটা জ্বর দিয়ে হলেও ‘হাড় বাঁকানো ব্যথাই’ বলে দেয় এ রোগ কতটা ভোগাতে পারে।

# চিকুনগুনিয়া হলে শরীরের গিটে গিটে ব্যথার পাশাপাশি মাথা কিংবা মাংসপেশিতে ব্যথা, শরীরে ঠাণ্ডা অনুভূতি, চামড়ায় লালচে দানা ও বমি বমি ভাব হতে পারে।

# চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা না করে জ্বর হলে প্যারাসিটামল সেবন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এন্টিবায়োটিক না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ভোগান্তি ও অভিযোগ

কাঁচামালের ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম ঢাকার মগবাজারে যে এলাকায় থাকেন, সেখানে প্রায় সব বাসাতেই কেউ না কেউ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে বলে তার ভাষ্য।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, রাজধানীর অন্যান্য এলাকাতেও পরিস্থিতি কমবেশি একই রকম বলে বন্ধু ও আত্মীয়দের কাছ থেকে তিনি জানতে পেরেছেন।    

এই রোগে আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়েছে নিম্নআয়ের শ্রমজীবী মানুষ। এমনিতে বসবাসের এলাকার পরিবেশের কারণে তাদের মশার উৎপাত বেশি সহ্য করতে হয়। আর চিকুনগুনিয়ায় যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, কাজ কামাই হওয়ায় তাদের রুটি-রুজি নিয়েও ভুগতে হচ্ছে।

জ্বর ছাড়লেও বেশ কিছুদিন শরীরে ব্যথা থাকে বলে রিকশাচালক বা নির্মাণ শ্রমিকের মত যাদের শারীরিক পরিশ্রম করতে হয়, তাদের সমস্যা হচ্ছে আরও বেশি। 

বর্ষার শুরুতে মশার যন্ত্রণা বেড়ে গেলেও সিটি করপোরেশন এ বিষয়ে তৎপর ছিল না বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীদের অনেকেই।

উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা মাসুদ রহমান গত কয়েকদিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। গায়ের ব্যথা আর অন্যান্য উপসর্গের কারণে এ জ্বর চিকুনগুনিয়া বলেই তার চিকিৎসকের ধারণা।

মাসুদের স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার এলাকায় গত ৩-৪ মাসের মধ্যে কেবল বৃহস্পতিবারই মশার ওষুধ ছিটাতে দেখেছেন তিনি।

“রাস্তার পাশের নালাগুলো তো ময়লা আবর্জনায় পূর্ণ থাকে। ওখানে মশা উৎপাদনের কারখানা। কিন্তু নালাগুলো ঠিকমত পরিষ্কার করা হয় না, নিয়মিত মশার ওষুধও ছিটায় না।”

মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা হোসাইন আহমদ চার দিন জ্বরে ভুগে উঠলেও সারা শরীরের ব্যথা এখনও কমেনি। তার অভিযোগ, সিটি করপোরেশনের তৎপরতার অভাবেই চিকুনগুনিয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে।

“আমাদের এলাকায় মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম খুব বেশি তো দেখলাম না। গত এক-দেড় মাসে তেমন কিছু তো আমার চোখে পড়েনি। চিকুনগুনিয়া এতোটা ছড়িয়ে পড়ার পরও তাদের সচেতনতামূলক কোনো কার্যক্রম আমার এলাকায় দেখছি না।”

গত ১১ জুলাই ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের আলোচনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের কণ্ঠেও ছিল একই অভিযোগের সুর।

সেদিন তিনি বলেন, “রাজধানী পরিষ্কার রাখতে এবং মশক নিধনে সিটি করপোরেশনের আন্তরিকতার অভাবে নগরীতে চিকুনগুনিয়া রোগের বিস্তার ঘটছে।”

পরে জাতীয় সংসদে ৩০০ বিধিতে দেওয়া  এক বিবৃতিতে মন্ত্রী বলেন, “চিকুনগুনিয়া হচ্ছে একটি ভাইরাস। এডিস মশা থেকে এর উৎপত্তি হয়। এই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। এর দায়িত্ব কোনোভাবেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়।

“তারপরও দায়িত্ববোধ থেকে আমরা চিকুনগুনিয়া নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা ও সচেতনতা নিয়ে কাজ করছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সকল ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।”

 

সেই এডিস মশা

>> চিকুনগুনিয়া রোগের সংক্রমণ ঘটে এডিস প্রজাতির এডিস ইজিপ্টি এবং এডিস এলবোপিকটাস মশার মাধ্যমে। চিকুনগুনিয়া ভাইরাসটি টোগা ভাইরাস গোত্রের। মশাবাহিত হওয়ার কারণে একে আরবো ভাইরাসও বলে।

>>  ডেঙ্গু ও জিকা ভাইরাসও এই মশার মাধ্যমে ছড়ায় এবং রোগের লক্ষণ প্রায় একই রকম। এ ধরনের মশা সাধারণত ভোর বেলা অথবা সন্ধ্যায় কামড়ায়। একটি পরিবারের একজন আক্রান্ত হলে মশার মাধ্যমে অন্যদেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

>> ঘরের ভেতরে অর্ধস্বচ্ছ পানি, ফুলের টব, ফেলে রাখা কৌটা বা বোতল, পানির ট্যাংক, ছাদে জমে থাকা পানি, পরিত্যক্ত টায়ার, আবর্জনার স্তুপ বা ডাবের খোসার ভেতরেও জন্ম নিতে পারে এডিস মশা। তাই বাড়ির ভিতরে, বাড়ির ছাদে যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে।

যে রিট আবেদনে হাই কোর্ট চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার রুল দিয়েছে, সেটি দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুজাউদ্দোলা আকন্দ।

ওই আবেদনের শুনানিতে গত ৯ জুলাই সুজাউদ্দোলা আদালতে বলেন, “খবর অনুযায়ী মশা নিধন প্রকল্পে কোটি কোটি টাকার বাজেট রয়েছে। কিন্তু এত টাকা যায় কোথায়? সেটাও দেখার দরকার।”

বিচারক তখন বলেন, “টাকাতো খরচ হচ্ছে। কিন্তু এখন যারা আক্রান্ত হচ্ছে তাদের বিষয়টাও দেখতে হবে। তাদের কি ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না? সম্প্রতি বিদ্যুতের ছেঁড়া লাইনে দুই হাত হারানো এক ছেলের জন্য ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশ হয়েছে। এখন ভবিষ্যতে এ বিষয়গুলোর প্রতি সংশ্লিষ্টরা খেয়াল রাখবে।”

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মশক নিধনে ব্যয় করেছে ৩৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এর আওতায় প্রতিদিন সকালে লার্ভিসাইডিং আর বিকেলে এডাল্টিসাইডিং করা হয় বলে করপোরেশনের কর্মকর্তাদের দাবি।

তবে সিটি করপোরেশনের ফগারম্যানরা নিয়মিত ওই কাজটি করেন না এবং যে ওষুধ ব্যবহার করা হয় তাতে ভেজাল থাকায় মশার তেমন কিছু হয় না বলে নগরবাসীর অভিযোগ রয়েছে।

প্রতিটি ওয়ার্ডে গড়ে পাঁচজন ফগারম্যান দিয়ে দিনে দুবার স্প্রে করা সম্ভব কি না সে প্রশ্নও বিভিন্ন আলোচনায় তুলেছেন কাউন্সিলররা।

চিকুনগুনিয়া সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে লিফলেট বিতরণে মেয়র সাঈদ খোকন

‘অভিজ্ঞতাটাই নতুন’

মন্ত্রীর অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ‘ব্যর্থ বা সফল’ এমন বিশেষণ তিনি ব্যবহার করতে চান না।

“ব্যাপারটা এমন না যে আমরা ব্যর্থ হয়েছি বা সফল হয়েছি। আমরা আমাদের কাজ করছি। আশা করছি আগামী ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে এটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।”

চিকুনগুনিয়া নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু করার নেই- স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের সঙ্গেও একমত নন মেয়র।

“একটা রোগের প্রাদুর্ভাব যখন আসে, তখন সম্মিলিতভাবেই তা প্রতিরোধ করতে হয়। তাদের অবশ্যই কিছু করার আছে। এ ধরনের বিদেশি রোগগুলো যেসব জায়গা দিয়ে আমাদের দেশে আসে সেসব জায়গায় নজরদারি বাড়ানো। চিকিৎসা সেবাসহ রোগটি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ তারা নিতে পারে।”

তবে চিকুনগুনিয়া রোগটি তুলনামূলকভাবে নতুন বলে ব্যবস্থা নিতে ‘কিছুটা দেরি’ হওয়ার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন মেয়র খোকন।

“এ রোগ নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতাটাই নতুন। আমরা এটার বিষয়ে কিছুই জানতাম না। আমাদের প্রস্তুতি ছিল ডেঙ্গু নিয়ে। এখন এটা উদ্ভব হয়েছে, আমরা সেদিকে নজর দিচ্ছি। আশা করছি ঠিক হয়ে যাবে।”

প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে নিজের এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শুক্রবার এক বিশেষ মশক নিধন কর্মসূচি শুরু করেছেন মেয়র খোকন। এর আওতায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সব লোকবল ও যন্ত্রপাতি একসঙ্গে করে একবারে একটি অঞ্চল ধরে অভিযান চালানো হবে।

১৫৬টি ফগার মেশিন নিয়ে ২৯৬ জন কর্মী ধারাবাহিকভাবে এ সিটির পাঁচটি অঞ্চলের ৫৭টি ওয়ার্ডে মশক নিধন অভিযানে অংশ নেবেন। তারা সকালে মশার লার্ভা নষ্ট করতে ডোবা ও নালাগুলোতে ওষুধ ছিটাবেন এবং বিকালে উড়ন্ত মশা মারতে ব্যবহার করবে ফগার মেশিন। সেই সঙ্গে চলবে সচেতনতামূলক প্রচার।

মশার ওষুধের মান নিয়ে নগরবাসীর প্রশ্ন সঠিক নয় দাবি করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. শেখ সালাহউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওষুধ কেনার জন্য সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি কমিটি আছে। সেখানে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধিরাও আছেন।

“সিটি করপোরেশন বর্তমান সময়ের জন্য সবচেয়ে কার্যকর ওষুধই কেনে। ওই ওষুধের মান নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই। কারণ সিটি করপোরেশন ছাড়াও বাকি দুটি জায়গায় এ ওষুধ পরীক্ষা করা হয়।”

চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে মেয়র আনিসুল হক

‘ঘরে গিয়ে তো মশা মারতে পারি না’

চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কার্যক্রম জানাতে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন মেয়র আনিসুল হক। তার সঙ্গে ছিলেন জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক তিন বিশেষজ্ঞ।

তারা বলেন, চিকুনগুনিয়া রোগের জন্য ঘরের বাইরের মশা নয়, বরং ঘরের ভেতরে জন্ম নেওয়া এডিস মশা দায়ী।

আর এর সূত্র ধরে মেয়র আনিসুল বলেন, “আপনার ঘরের ভেতরে গিয়ে আমি মশারি টানাতে পারব না। আপনার চৌবাচ্চায় আমি ওষুধ লাগাতে পারব না। আপনার ঘরের ভেতর সামান্য স্বচ্ছ পানিতে যে মশা জন্মাচ্ছে, সেটা আমি মারতে পারব না।”

করপোরেশনের যেখানে মশা মারার কথা তার চেয়ে বেশি মারা হচ্ছে বলে দাবি করে ঢাকা উত্তরের মেয়র বলেন, “এরপর আর কি করব বুঝতে পারছি না।”

নগরবাসী চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় দুঃখ ও সমবেদনা প্রকাশ করলেও তাদের এ দুর্ভোগের জন্য সিটি করপোরেশন দায়ী নয় বলে মেয়র আনিসুলের ভাষ্য।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত এপিডেমিওলজিস্ট বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান, কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ উদ্দীন আহমেদ ও মনজুর এ চৌধুরী মশা নিধনের পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন।

এদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তরফ থেকে আগাম তথ্য না পাওয়ার কারণেই চিকুনগুনিয়া এবার বেশি ছড়িয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএমএম সালেহ ভূঁইয়া।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “চিকুনগুনিয়ার কথা আমরা আগে খুব একটা শুনিনি। ২০০৮ সালে একবার দেশের দুতিনটা জায়গায় এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার কথা শুনেছিলাম। কিন্তু এবার এই রোগের ভাইরাসটা যে এইখানে আসল, এটা কি বিদ্যমান যে লো প্রোফাইলে ছিল সেটা হঠাৎ করে বাড়ল, নাকি বাইরে থেকে আসল? কমিউনিকেবল ডিজিজ নিয়ে একটা দপ্তর আছে, তারা কী কোনো পূর্বাভাস দিতে পারতো না যে ঢাকা বা দেশের অন্য কোনো জায়গায় এই রোগটা আক্রমণ করতে পারে?”

মহামারী?

মোটামুটি কত লোক এবার বর্ষা মৌসুমে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে সে বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান সরকারের কোনো দপ্তরের হাতে নেই। তারপরও এর ব্যাপকতার কারণে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ একে মহামারী বলছেন।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১২ জুলাই পর্যন্ত তাদের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে ৬৪৯ জনকে চিকুনগুনিয়া রোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।

কিন্তু আইইডিসিআর ও বঙ্গন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোথাও চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার সুযোগ না থাকায় আক্রান্ত অধিকাংশের তথ্যই সরকারের খাতায় আসছে না। 

স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম গত ১১ জুলাই জানান, জ্বরে আক্রান্ত প্রতি ১১ জনের মধ্যে একজন এখন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। ঢাকার বাইরে যে দু-একজন রোগীর তথ্য পাওয়া গেছে তারা ঢাকা থেকেই আক্রান্ত হয়েছিলেন।

কিন্তু আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রতি ১১ জনে একজন এই রোগে ভুগছে বলে যে খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তা সঠিক নয়।

টেলিফোনভিত্তিক এক অসম্পূর্ণ জরিপ ধরে ওই প্রতিবেদন করা হয়ে থাকতে পারে জানিয়ে আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই জরিপে অংশ নেওয়া ৪ হাজার ৭৭৫ জনের মধ্যে ৩৫৭ জন জ্বর ও গিঁটে ব্যথার কথা বললেও তাদের পরীক্ষা করা হয়নি বলে চিকুনগুনিয়া হয়েছে কি না তা এখনই বলা সম্ভব নয়।

ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন শুক্রবার তার মশক নিধন কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দাবি করেন, তার এলাকায় চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব কম, একে মোটেই মহামারী বলা যাবে না।

অন্যদিকে উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইইডিসিআরের সাবেক এপিডেমিওলজিস্ট অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলেন, “এখন পর্যন্ত এ রোগের যেভাবে বিস্তার ঘটেছে, যে পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, তাতে অবশ্যই এটা মহামারী।”   

তার বক্তব্য সমর্থন করলেও এটি তাদের ব্যক্তিগত মত জানিয়ে কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ উদ্দীন আহমেদ বলেন, মহামারী কিনা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।