ফরহাদ মজহার আদাবর থানায়

যশোরে একটি বাস থেকে নাটকীয়ভাবে ‘উদ্ধারের’ পর ফরহাদ মজহারকে ঢাকার আদাবর থানায় আনা হয়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 July 2017, 04:55 AM
Updated : 4 July 2017, 02:21 PM

আদাবর থানায় এএসআই সাখাওয়াত হোসেন জানান, মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে তাদের একটি দল ফরহাদ মজহারকে নিয়ে থানায় পৌঁছায়।

ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতার, মেয়ে সমতলী হকসহ পরিবারের সদস্যরাও সেখানে রয়েছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী তার বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে এএসআই সাখাওয়াত জানিয়েছেন।  

সোমবার সকালে ফরহাদ মজহারের পরিবার অপহরণের অভিযোগ করার পর মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে সন্ধ্যায় খুলনা অঞ্চলে অভিযান শুরু করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ওই অভিযানের মধ্যে রাত সাড়ে ১১টার দিকে যশোরের নওয়াপাড়ায় ঢাকাগামী একটি বাসে তাকে পাওয়ার কথা জানান র‌্যাব-৬ এর অধিনায়ক খন্দকার রফিকুল ইসলাম।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, নওয়াপাড়ায় পাওয়ার পর ফরহাদ মজহারকে প্রথম অভয়নগর থানায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে খুলনায় নিয়ে গিয়ে রাত দেড়টার দিকে ঢাকার পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

পরিবার অপহরণের কথা বললেও পুলিশের খুলনা রেঞ্জের উপ মহাপরিদর্শক দিদার আহম্মেদ রাতে ফুলতলা থানায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ফরহাদ মজহার অপহরণের ‘নাটক’ সাজিয়েছিলেন বলে তাদের সন্দেহ।

“একজন সুস্থ মানুষ যেভাবে জার্নি করে, সেভাবেই তিনি ছিলেন। তার সঙ্গে একটি ব্যাগ ছিল, গেঞ্জি ছিল। কিছু টাকাও ছিল। এমনকি মোবাইল চার্জার নিতেও ভোলেননি তিনি।”

ডিআইজি দিদার বলেন, “এতে করে অপহরণের বিষয়টি প্রমাণ হয় না। মনে হয় না এটা অপহরণ।”

উদ্ধারের তিন ঘণ্টা আগে ফরহাদ মজহারকে খুলনায় নিজের রেস্তোরাঁয় দেখার দাবি করেছিলেন ‘নিউ গ্রীল হাউস’র মালিক আব্দুল মান্নান।

খুলনার নিউ মার্কেটের সামনে এই রেস্তোরাঁটি। মান্নানের কাছে খবর পাওয়ার পর র‌্যাব জোর অনুসন্ধান শুরুর কথা জানায়।

র‌্যাব কর্মকর্তা রফিকুল বলেন, “ফরহাদ মজহার খুলনার শিববাড়ী মোড় থেকে রাত সোয়া ৯টায় হানিফ পরিবহনের একটি বাসে ঢাকা রওনা হয়েছিলেন।”

শাহরিয়ার পলক নামে একজন নিজেও ওই বাসে ছিলেন দাবি করে তার ফেইসবুক পাতায় লিখেছেন, “খুলনা থেকে আসছি হানিফের বাসে করে! নোয়াপাড়ায় হঠাৎ করে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা হল! সুপারভাইজার কোনো কথার উত্তর দিলো না। প্রায় ৪০ মিনিট পর ৩টি র‍্যাবের গাড়ি এসে তল্লাশি করলো, আর বাসের পেছনের সিট থেকে উদ্ধার হলো - নিখোঁজ কবি ফরহাদ মজহার.....।”

ফরহাদ মজহার যে টিকেটে ওই বাসে উঠেছিলেন, সেখানে যাত্রীর নামের জায়গায় ‘গফুর’ লেখা ছিল বলে যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমানের ভাষ্য।

রাতে ফরহাদ মজাহার উদ্ধার পাওয়ার পর তার স্ত্রী ফরিদা আখতার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, মানবাধিকারকর্মী, সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সচেষ্ট হলে সবকিছুই সম্ভব।”

ভোর থেকে নিখোঁজ

সোমবার রিং রোডের ভোর ৫টায় বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে ফরহাদ মজহার নিখোঁজ বলে তার স্বজনরা আদাবর থানায় গিয়ে অভিযোগ জানালে পুলিশ অনুসন্ধানে নামে।

ফরিদা আখতার সাংবাদিকদের বলেন, ফরহাদ মজহার ভোরে লেখালেখি করেন। সাধারণত বের হন না। এদিন ভোরেও কম্পিউটারের সামনে স্বামীকে দেখেছিলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর দেখতে না পেয়ে খোঁজাখুঁজির মধ্যে একটি ফোন পান। তাতে ফরহাদ মজহার বলেন, তাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, মেরে ফেলবে।

এরপর উদ্বিগ্ন হয়ে বিষয়টি পুলিশে জানায় পরিবার। তখন পুলিশ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রিং রোডের হক গার্ডেনের চার তলায় ফরহাদ মজহারের বাসায় যায়।

আদাবর থানার এসআই মহসিন আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফরহাদ মজহার সকাল ৫টা ৫ মিনিটে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন বলে সিসিটিভি ভিডিও দেখে তারা নিশ্চিত হয়েছেন।”

ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছি। তবে বিষয়টি এখনও বেশ রহস্যজনক।”

আদাবর থানা থেকে তিনশ গজ দূরে ফরহাদ মজহারের বাসা। ওই বাড়ির দারোয়ান মো. আলি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে হেঁটে ছোট ফটক দিয়ে বেরিয়ে সড়কে উঠতে দেখেছেন ফরহাদ মজহারকে।

তাকে কেউ উঠিয়ে নিয়ে গেছে, এমন কোনো দৃশ্য তার চোখে পড়েনি বলে জানান তিনি।

পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, শ্যামলী রিং রোড হক গ্যারেজের মোড় থেকে শ্যামলীর দিকে যেতে একটি হাসপাতাল রয়েছে। এই হাসপাতালের সামনে ওই সময় একটি মাইক্রোবাস ছিল। পরে সেটি আর দেখা যায়নি। সেই মাইক্রোবাসের সূত্র ধরে তাদের কাজ চলছে।

ওই হাসপাতালের সামনে পুলিশের একটি তল্লাশি চৌকিও রয়েছে।

বিকালে খুলনা এলাকায় ফরহাদ মজহারের মোবাইল ফোনের অবস্থান শনাক্ত করার কথা জানানো হয় পুলিশের পক্ষ থেকে।

খুলনার র‌্যাব কর্মকর্তা রফিকুল রাত পৌনে ৯টার দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিকাল সাড়ে ৫টা থেকে নগরীর সোনাডাঙ্গার ইব্রাহিম মিয়া সড়কের দুই পাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওই এলাকার প্রতিটি বাড়িতে তল্লাশি চলছে।”

খুলনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বয়রা এলাকায়ও অভিযান চালানো হয়েছে, তবে সেখানেও তাকে পাওয়া যায়নি।

কারা ফরহাদ মজহারকে ধরে নিয়ে গেছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পরিবারের সদস্যদের কাছে পাওয়া যায়নি। তবে একদিন আগে ভারতে মুসলিম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে একটি কর্মসূচিতে তার যোগ দেওয়ার কথা বলেন তারা।

বিএনপি জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করে, সরকারের কোনো সংস্থাই ফরহাদ মজহারকে অপহরণ করেছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনও ফরহাদ মজহারকে দ্রুত উদ্ধারে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।

কবি-প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ আন্দোলনের সমালোচনামূলক বিভিন্ন বক্তব্যের জন্য আলোচিত।

শাহবাগের ওই আন্দোলনের বিরোধিতাকারী হেফাজতে ইসলামের পক্ষে বিভিন্ন সভা সমাবেশে বক্তব্য দিতেও দেখা যায় তাকে।

জাসদের প্রতিষ্ঠাতা তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খান দাদাভাইয়ের মামাত ভাই ফরহাদ মজহার নিজেকে মার্কসিস্ট হিসেবে পরিচয় দেন। তবে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিয়ে বাম দলগুলোর সমালোচনা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের হরতালের মধ্যে সংবাদকর্মীদের ওপর হামলার প্রেক্ষাপট হিসেবে একুশে টেলিভিশনের ‘টকশো’তে বিভিন্ন গণমাধ্যমকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যায়াতি করে গণমাধ্যমের ওপর হামলাকে ‘সঠিক’ বলে মন্তব্য করেছিলেন ৭০ বছর বয়সী ফরহাদ মজহার।

ওই সময় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে এক সভায় আরও কঠোর আন্দোলনে যাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসিতে পড়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে অর্থনীতিতে ডিগ্রি নেন ফরহাদ মজহার। দেশে ফিরে তিনি উবিনীগ নামে একটি এনজিও গড়ে নয়াকৃষি আন্দোলন শুরু করেন।

চিন্তা নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক ফরহাদ মজহার সব সময় লুঙ্গি পরে থাকেন, যা নিয়েও রয়েছে আলোচনা।