লাশ না পাওয়ার দুঃখ হলি আর্টিজানের পাচক সাইফুলের পরিবারে

এক বছর আগে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর কমান্ডো অভিযানে পাঁচ জঙ্গির সঙ্গে নিহত পাচক সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের স্মৃতি মনে করে এখনও চোখের জল ফেলেন স্বজনরা। অনেক চেষ্টার পরও লাশ না পাওয়ার কষ্ট এখনও ভুলতে পারছেন না তারা।

কে এম রায়হান কবীর শরীয়তপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 June 2017, 05:22 AM
Updated : 30 June 2017, 05:40 AM

হামলাকারীদের সঙ্গে লাশ মেলায় সাইফুলের গায়েও লেগে গিয়েছিল ‘জঙ্গি তকমা’। পরে স্বজনরা তাকে বেকারির পাচক হিসেবে সনাক্ত করলেও লাশ আর ফেরত পায়নি। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকেও মেলেনি কোনো সহায়তা।

তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে সাইফুলের স্ত্রী সোনিয়া আকতারের এখন দিন কাটে খেয়ে-না খেয়ে। সন্তানদের ভবিষ্যত চিন্তাতেই অস্থির থাকতে হয় তাকে।

গতবছর ১ জুলাই কয়েকজন যুবক অস্ত্রহাতে হলি আর্টজানে ঢুকে ভেতরে থাকা লোকজনকে জিম্মি করে। পরদিন কমান্ডো অভিযানে নিরাপত্তা বাহিনী হলি আর্টিজানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর জিম্মি ২০ জনের মৃতদেহের পাশাপাশি আরও কয়েকজনের লাশ উদ্ধার করে।

হামলাকারী হিসেবে পাঁচজনের লাশের ছবি সাংবাদিকদের পাঠায় পুলিশ। তার আগেই জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের বরাতে পাঁচ হামলাকারীর ছবি আসে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের মাধ্যমে।

পুলিশের দেওয়া ছবিগুলোর মধ্যে চারটির সঙ্গে আইএসের দেওয়া চারজনের ছবির মিল পাওয়া গেলেও মিলছিল না শেফের পোশাক পরা একজনের চেহারায়।

পরে সাদা অ্যাপ্রন পরা ওই ব্যক্তিকে হলি আর্টিজান বেকারির ‘শেফ’ সাইফুল ইসলাম চৌকিদার বলে শনাক্ত করেন তার স্বজনরা।

হলি আর্টিজানে সাইফুল ইসলাম (ফাইল ছবি)

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কলুকাঠি গ্রামের মৃত আবুল হাসেম চৌকিদারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সাইফুল। তার ছোট ভাই বিল্লাল মালয়েশিয়ায় থাকেন। তিন বোনের সবার বিয়ে হয়েছে, থাকেন স্বামীর বাড়িতে।

১০ বছর জার্মানিতে থাকার পরে দেশে ফিরে নিহত হওয়ার দেড় বছর আগে হলি আর্টিজানে পিৎজা তৈরির শেফ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন সাইফুল।

নিহত হওয়ার পর থেকে পুলিশ সাইফুলকে জঙ্গি হিসেবে প্রচার করে। হামলার খবর টেলিভিশনে প্রচার হতে দেখে পরিবারের লোকজন ওই রাতে সাইফুলকে ফোন করে না পেয়েই শুরু করে আহাজারি। পরে স্বজনরা ঢাকায় গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন।

তদন্তকালে সাইফুলের মা সমেরা বেগমকে ছেলের লাশ শনাক্তের জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করতে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য ও নড়িয়া থানা থেকে সাইফুলের নামে প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তিন মাস তদন্ত শেষে বেওয়ারিশ হিসেবে সাইফুলের লাশ দাফনের জন্য আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামে হস্তান্তর করে। নিহত জঙ্গিদের সঙ্গেই জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।

ঈদের আগে সাইফুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্ত্রী আর তিন সন্তান- কারো জন্যই কেনা হয়নি নতুন কাপড়।  

সাইফুলের বিষয়ে প্রশ্ন করতেই কেঁদে বুক ভাসান তার স্ত্রী সোনিয়া, দুই মেয়ে সামিয়া (১০), ইমলি (৮)।

সাইফুল যখন নিহত হন, তখন সোনিয়া সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এর তিন মাস পর জন্ম হয় ছেলে হাচানের। 

বড় মেয়ে সামিয়া বাড়ির পাশে মা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে আর ইমলি প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। মালয়েশিয়া প্রবাসী সাইফুলের ছোট ভাই বিল্লালকেই দায়িত্ব নিতে হয়েছে তাদের ভরণ-পোষণের।

সাইফুলের মা সমেরা বেগম বলেন, “সাইফুল বলেছিল ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসবে, সবার সাথে ঈদ করবে। সে ঈদ তো করতে পারে নাই। লাশটা ফেরত এনে বাপ-দাদার মাটিতে কবর দিতেও পারি নাই। এ কষ্ট সহ্য করার নয়।”

ছেলেকে নিরাপরাধ দাবি করে তিনি বলেন, “সে পোশাক পরা অবস্থায় মারা যাওয়ার পরেও তাকে জঙ্গি বলে প্রচার করা হয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আমাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারপরও আমার ছেলের লাশ ফেরত দেওয়া হয়নি। লাশটা ফেরত পেলে সারা জীবন ওর সন্তানেরা বাবার কবর দেখে শান্তি পেত।”

সাইফুলের স্ত্রী সোনিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, মারা যাওয়ার এক মাস আগে বাড়ি এসেছিলেন সাইফুল। ১ জুলাই ঘটনার দিন বিকালে শেষবারের মতো দুজনের কথা হয়েছিল।  

তিনি বলেন, ঘটনার খবর পেয়ে বার বার ফোন করা হলেও সাড়া না দেখে ঢাকায় থাকা তার আত্মীয় স্বজনেরা খোঁজ নিয়ে মৃত্যুর খবর জানায়।

“বার বার সরকারের পক্ষ থেকে লাশ ফেরতের আশ্বাস দিয়েও বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে তাকে দাফন করা হয়।”

অসহায় সোনিয়া সন্তানদের দেখিয়ে বলেন, “এদের কী হবে? আমি পরের উপর ভর করে কতদিন চলব? কী করে আমি বাঁচব? সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে কোনো সহায়তা করা হয়নি। আমি শিশুদের নিয়ে অসহায়।”