রবিউলের স্বপ্ন পূরণে সহযোগিতা চান স্ত্রী

মানিকগঞ্জে নিজের এলাকায় প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য একটি বিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম; এটি আরও বড় করার পাশাপাশি একটি বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলার স্বপ্নও ছিল তার।

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধিমাহবুব আলম রাসেলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 June 2017, 04:59 AM
Updated : 1 July 2017, 04:05 AM

কিন্তু এক বছর আগে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় রবিউলের মৃত্যু তার স্বপ্নপূরণের পথও রুদ্ধ করে দেয়। স্বামীর সেই স্বপ্ন পূরণে সবার সহায়তা চাইছেন উম্মে সালমা।

২০১৬ সালে হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলার সময় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন রবিউল।

রাতে হামলার খবর শুনেই রবিউল ছুটে যান ঘটনাস্থলে। তিনি ও বনানী থানার ওসি মো. সালাউদ্দিন শুরুতেই জঙ্গিদের হামলায় নিহত হন। রেস্তোরাঁটির দখল নিয়ে ১৭ বিদেশিসহ ১৯ জনকে হত্যা করেছিল জঙ্গিরা। পরদিন সেনাবাহিনীর অভিযানে নিহত হন পাঁচ জঙ্গি।

রবিউল নিহত হওয়ার সময় অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন সালমা। এক মাস পর পৃথিবীতে আসে কামরুন্নাহার রায়েনা। বাবার স্নেহ পায়নি শিশুটি।

১১ মাস বয়সী রায়েনা এবং দুই বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে রবিউলের বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার কাটিগ্রামেই আছেন সালমা।

জঙ্গি হামলায় আহত রবিউলকে বের করে আনছেন সহকর্মীরা (১ জুলাই, ২০১৬ এর ছবি)

গুলশান হামলার বছর পূর্তির আগে বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ঘরে খাটে বসে রায়েনাকে খাওয়াচ্ছেন সালমা। ঘরের ভেতরই টেনিস বল নিয়ে খেলছে বড় সন্তান সাজিদুল করিম। মেয়েকে খাওয়ানোর পাশাপাশি ছেলের দুষ্টুমিও সামলাতে হচ্ছে তাকে।

এক বছর আগে স্বামীকে হারানোর শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি সালমা। তার মধ্যেই অকাল প্রয়াত স্বামীর স্বপ্নের কথা বলেন তিনি।

ঈদ কেমন কেটেছে- জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সালমা বলেন, “ঈদ মানে আনন্দ। স্বামীকে হারানোর পর সেই আনন্দ মাটিচাপা পড়ে গেছে।”

স্বামীর কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “প্রতিবন্ধী শিশুদের খুব ভালোবাসত রবিউল।”

শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতাহীন শিশু ও কিশোরদের জন্য বাড়ির অদূরে বাসাই গ্রামে ২০১১ সালে রবিউল প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিকনিং লাইট অরগানাইজেশন অব ম্যানকাইন্ড অ্যান্ড সোসাইটি (ব্লুমস)’ নামে বিশেষায়িত বিদ্যালয়টি।

পেশাগত কাজের ফাঁকেই তিনি এর দেখাশোনা করতেন। এছাড়া তিনি গ্রামের শিশুদের লেখাপড়ার জন্য নজরুল বিদ্যাসিঁড়ি নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও গড়ে তোলেন।

রবিউলের খবর শুনে হলি আর্টিজান বেকারির সামনে তার শ্বশুর শাজাহান (১ জুলাই, ২০১৬ এর ছবি)

বর্তমানে বিশেষায়িত বিদ্যালয়টিতে ৩২ জন প্রতিবন্ধী শিশু পড়ালেখা করছে জানিয়ে সালমা বলেন, “স্কুলটি আবাসিক করা এবং সেখানে একটি বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করাও তার স্বপ্ন ছিল। তার মৃত্যুর পর তা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।”

নিজের একার পক্ষে সম্ভবপর নয় বলে রবিউলের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার আবেদন জানান সালমা।

ঢাকার ধামরাই উপজেলার দেপাশা গ্রামের মোহাম্মদ শাহজাহানের মেয়ে সালমার সঙ্গে ২০০৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা রবিউলের বিয়ে হয়। সালমা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী।

বিয়ের দুই বছরে মাথায় তাদের প্রথম সন্তান সাজিদুলে জন্ম। সে এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কলতান বিদ্যানিকেতন নামে একটি বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে।

রবিউলের পড়াশোনাও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে পুলিশের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।

সালমা বলেন, “তার (রবিউল) ইচ্ছে ছিল প্রকৃত শিক্ষায় সন্তানরা শিক্ষিত হবে। মানুষ ও দেশের সেবায় কাজ করবে। ওদের বাবা সব সময় মানুষের সাথে ভালো আচরণ করেছেন, তাদের জন্য কাজ করেছেন। দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। আমিও চাই সন্তানরা বাবার মতো মানুষ হোক।”

রবিউল ইসলাম

পরিবারে দুই ভাইয়ের মধ্যে রবিউল ছিলেন বড়। তার ছোট ভাই শামসুজ্জামান শামস ঢাকার সাভারের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন।

শামস বলেন, রবিউল মারা যাওয়ার পর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে এক অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক যোগ্যতা অনুযায়ী সালমাকে একটি চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনার কথাও পুলিশ প্রধান জানিয়েছিলেন।

তবে সাত-আট মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও তার কোনো সুরাহা হয়নি।

রবিউলের মৃত্যুর পর পুলিশ বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক অনুদান পেয়েছেন সালমা। ওই অর্থ দিয়েই সংসারের খরচ চালাচ্ছেন তিনি। তবে কোনো চাকরি পেলে চিন্তামুক্ত হতে পারেন তিনি।

সালমা বলেন, “চাকরিটা পেলে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ তৈরি হত। এতে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় পড়তে হবে না।”