সিটিসেলের নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সাড়ে তিনশ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
Published : 28 Jun 2017, 05:11 PM
বুধবার রাজধানীর বনানী থানায় করা এই মামলায় বিএনপির এই ভাইস চেয়ারম্যানের স্ত্রী নাসরিন খান, সিটিসেলের এমডি এবং এবি ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান এমডিসহ মোট ১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।
দুদকের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মামলাটি দায়ের করেছেন সংস্থার উপ-পরিচালক শেখ আবদুস ছালাম।
সিটিসেলের নামে এবি ব্যাংকের গ্যারান্টি নিয়ে আটটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অনিয়মের মাধ্যমে ৩৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাত করার অভিযোগ আনা হয়েছে মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে।
প্রণব ভট্টাচার্য্য বলেন, “মোরশেদ খান ও তার স্ত্রী ছাড়াও প্যাসিফিক টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেডের কর্মকর্তা ও এবি ব্যাংকের সংশ্লিষ্টদের আসামি করা হয়েছে মামলায়।”
মোবাইল ফোন অপারেটর সিটিসেলের মূল কোম্পানির নাম প্যাসিফিক টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড (পিবিটিএল)। এম মোরশেদ খান এর চেয়ারম্যান, তার স্ত্রী নাছরিন খানও একজন পরিচালক।
দেনার দায়ে গত বছর বন্ধ হয়ে যাওয়া সিটিসেলের হাত ধরেই দেড় যুগ আগে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন সেবার যাত্রা শুরু হয়েছিল।
পিবিটিএলের ভাইস চেয়ারম্যান আসগর করিম ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহবুব চৌধুরীর নামও রয়েছে এ মামলার আসামিদের তালিকায়।
অন্য আসামিরা হলেন- এবি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাইজার আহমেদ, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ফজলুর রহমান, সাবেক উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ক্রেডিট) ও বর্তমানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মসিউর রহমান চৌধুরী, ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেণ্ট সালমা আক্তার, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম আহম্মেদ চৌধুরী, এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মহাদেব সরকার সুমন।
এছাড়া ব্যাংকটির এসভিপি ও রিলেশনশিপ ম্যানেজার সৈয়দ ফরহাদ আলম, সাবেক এসভিপি ও রিলেশনশিপ ম্যানেজার আরশাদ মাহমুদ খান ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, অপারেশনস বিভাগের সিনিয়র অ্যাসিসটেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহানুর পারভীন চৌধুরী, সাবেক এভিপি ও মহাখালী শাখা ব্যবস্থাপক জার ই এলাহী খান এবং রিলেশনশিপ অফিসার মো. কামারুজ্জামানকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে।
“ঋণ প্রদান সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার উপেক্ষা করে জামানতবিহীন ব্যাংক গ্যারান্টি ইস্যু করার জন্য এবি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহায়তায় চারটি বোর্ড সভার মাধ্যমে ৩৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার ‘অপরিবর্তনীয় শর্তবিহীন’ ব্যাংক গ্যারান্টি অনুমোদন করা হয়।”
পরে ওই ‘অপরিবর্তনীয় শর্তবিহীন’ ব্যাংক গ্যারান্টি ‘সহায়ক জামানত’ হিসেবে ব্যবহার করে পিবিটিএল ঢাকা ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি টাকা, আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ৫০ কোটি টাকা, সিটি ব্যাংক থেকে সাড়ে ৩৮ কোটি টাকা, এনসিসি ব্যাংক থেকে ৫০ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক থেকে ১০ কোটি টাকা, পূবালী ব্যাংক থেকে ৩০ কোটি টাকা, সাবিনকো লিমিটেড থেকে ২৩ কোটি টাকা এবং ফিনিক্স লিমিটেড থেকে ৪৭ কোটি টাকাসহ এক বছর মেয়াদে মোট ৩৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ নেয়।
কিন্তু পিবিটিএল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওই ঋণ শোধ না করায় শর্ত অনুসারে এবি ব্যাংক গ্যারান্টির বিপরীতে পে-অর্ডারের মাধ্যমে সুদসহ ৩৮৩ কোটি ২২ লাখ ১০ হাজার ৩৬৩ টাকা ওই ব্যাংকগুলোকে পরিশোধ করে।
ওই অর্থকে পিবিটিএলের আত্মসাৎ করা অর্থ হিসেবে বর্ণনা করে এজাহারে বলা হয়, একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ওই বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নেওয়ার সুযোগ না থাকার পিবিটিএল এবি ব্যাংকের ব্যাংক গ্যারান্টি ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে ওই টাকা ঋণ নেয়। আর এবি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাতে সহযোগিতা করেন।
পিবিটিএল এবি ব্যাংকের মহাখালী শাখায় জামানতবিহীন ঋণের জন্য আবেদন করার পর ২০১১ সালের ২১ মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত ওই অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটে বলে দুদকের অভিযোগ।
১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (বিটিএল) নামে টেলিকম সেবা পরিচালনার লাইসেন্স পায় বর্তমান সিটিসেল। পরের বছর হংকং হাচিসন টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেড এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে বিটিএল নাম বদলে হয় হাচসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (এইচবিটিএল)।
১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় আবার পরিবর্তন আসে। মোরশেদ খানের মালিকানাধীন প্যাসিফিক মটরস ও ফারইস্ট টেলিকম মিলে এইচবিটিএল-এর শেয়ার কিনে নেয়। কোম্পানির নাম বদলে হয় প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড, ব্র্যান্ডিং শুরু হয় সিটিসেল নামে।
বিএনপি সরকার আমলে এই একটি কোম্পানি একচেটিয়া ব্যবসা করেছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর আরও কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়া হলে তাদের একচেটিয়া ব্যবসার অবসান ঘটে।
এরপর ধুকতে থাকা এই কোম্পানিতে ২০০৪ সালে বিনিয়োগ করে সিঙ্গাপুরের সিংটেল। কিন্তু ব্যবসার আর প্রসার ঘটেনি।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ কোম্পানির ৩৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক মোরশেদ খানের প্যাসিফিক মোটরস লিমিটেড।