ঘুরে দাঁড়াচ্ছে রাঙামাটি

এক সপ্তাহ আগের পাহাড় ধসের ভয়াল ক্ষত নিয়েই উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছে পার্বত্য জেলা রাঙামাটি।

মিন্টু চৌধুরী রাঙামাটি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 June 2017, 04:52 PM
Updated : 19 June 2017, 07:31 PM

রাঙামাটির মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর এই প্রয়াসের কথা তুলে ধরতে গিয়ে নানা বিরূপতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার।

পাহাড় ধসে বিপর্যয় নেমে আসার সাত দিন পর সোমবার জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে গত কয়েক দিনের চেয়ে অনেক বেশি মানুষের আনাগোনা দেখা যায়।

খুলেছে পেট্রোল পাম্প, মিলছে জ্বালানি। আগের ভাড়ায় চলছে অটোরিকশা। দোকানপাট খুলেছে, কিছুটা বেশি দরে হলেও মিলছে নিত্য পণ্য।

বিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ পুনঃস্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে। পানি মিলছে নিয়মিত, বিদ্যুৎ সরবরাহ রয়েছে।

বনরূপা, কাঁঠালতলি, রিজার্ভ বাজার, ভেদভেদি বাজারসহ আশেপাশের এলাকায় প্রায় আগের মতোই অটো রিকশা, মোটর সাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করতে দেখা গেছে।

বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নিত্য পণ্যের দোকানে মানুষের আনাগোনো ছিল। চারটি পেট্রোল পাম্প থেকে জ্বালানি তেল নিতে দেখা গেছে অটোরিকশার চালকদের।

ধসে ঘর হারানো কাউকে মেরামত করতে দেখা গেছে। কাউকে দেখা গেছে ঝুঁকিহীন নতুন ঠিকানা খুঁজে নিতে।

সদরের নতুন পাড়ার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম (৬৫) সেমিপাকা একটি ঘরে ভাড়া থাকতেন। মঙ্গলবার সে ঘরে কাদাপানি ঢুকছিল।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘর পরিষ্কার করে বুধবার রাত থেকে থাকছি। তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আজকে বাসায় বিদ্যুৎও এসেছে।”

নতুন পাড়ার আরেক বাসিন্দা শাহ আলমের টিনশেড ঘরটি মঙ্গলবার মাটিচাপা পড়েছিল। তাই আরেকটি নতুন বাসা ভাড়া নিয়ে পরিবারসহ সেখানে উঠেছেন তিনি।

ছবি: সুমন বাবু

আসবাবপত্রের মিস্ত্রি নুরুল আলম ও তার স্ত্রী লাইজু বেগম নতুন পাড়ায় ছয় বছর আগে একটি টিনশেড ঘর তৈরি করেছিলেন। মঙ্গলবার কাদামাটি ঢুকে সেই ঘর হয়ে পড়ে বসবাসের অনুপযোগী।

শনিবার পর্যন্ত ছিলেন আশ্রয় কেন্দ্রে। গত কয়দিন ঘর থেকে আসবাবপত্র বের করে পরিষ্কার করেছেন তারা।

সোমবার শহরের কাঁঠালতলি লেকার্স রোডে নতুন বাসা ভাড়া নিয়েছেন লাইজু-নুরুল আলম।

লাইজু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জীবন তো চালাতে হবে। তাই অন্য বাসায় চলে যাচ্ছি। তিন ছেলেমেয়ের সব বইপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। আগামী মাসে বড় মেয়েটার স্কুলের পরীক্ষা।”

পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তার আশ্বাস ইতোমধ্যে দিয়েছেন জেলা প্রশাসক মানজারুল মান্নান। 

পোস্ট অফিস কলোনির বাসিন্দা জান্নাতুল ফেরদৌসকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আগের ঘরেই ফিরতে দেখা গেছে।

ছবি: সুমন বাবু

এসব এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, ধসে পড়া ঘরবাড়ি মেরামত করেই কিছু কিছু লোকজন আবারও থাকতে শুরু করেছেন।

প্রশাসনের প্রাথমিক হিসাবে পুরো রাঙামাটি জেলায় প্রায় ১৭০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এর মধ্যে সদরের ভেদভেদি পাড়ায়ই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১১৩০টি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম এই পাহাড় ধসে শুধু রাঙামাটিতেই মারা গেছেন ১১৮ জন।  

সংসদ সদস্য  উষাতন তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা বড় মানবিক বিপর্যয়। আমরা শোকাহত, কিন্তু রাঙামাটির মানুষ দমবার পাত্র নয়।

“উদ্ধার তৎপরতায় আধুনিক যন্ত্রপাতি, পূর্ব প্রস্তুতি ও সমন্বয়ের অভাব ছিল। কিন্তু সদিচ্ছা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে সবাই কাজ করছেন।”

জেলা প্রশাসক মানজারুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, এখন পানির সংকট নেই। বিদ্যুৎও আছে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনের কাজও এগিয়ে চলেছে।

সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে নিরলস কাজ করে যাওয়ায় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরকে ধন্যবাদ জানান জনসংহতি সমিতির নেতা উষাতন।

পাহাড় ধসে চট্টগ্রামের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রাঙামাটির; এখন নৌপথেইে আসছে পণ্য।

“বিচ্ছিন্ন জনপদ স্বাভাবিক হতে শুরু হয়েছে। আরও স্বাভাবিক করতে যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি করতে হবে,” বলেন উষাতন। 

বিভিন্ন উপজেলা থেকে নৌপথে খাদ্য শস্য রাঙামাটি সদরে আসছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আছে। জ্বালানি তেলেরও সঙ্কট নেই।

রাঙামাটি অটোরিকশা চালক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহীদুজ্জামান রোমান বলেন, “জ্বালানি তেলের দাম স্বাভাবিক আছে। সরবরাহ পাওয়া গেছে।”

চালকরা নির্ধারিত দামে তেল কিনতে পারায় গাড়ির ভাড়াও স্বাভাবিক আছে।

ছবি: সুমন বাবু

ধসের পর কিছু ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিলেও এখন তা স্বাভাবিক হয়ে আসায় মানুষের মনে স্বস্তি ফিরেছে বলে জানান সংসদ সদস্য উষাতন।

জেলা প্রশাসক বলেন, “বিধস্ত যে অবস্থা ছিল সেখান থেকে দিন দিন উন্নতি হচ্ছে। স্বাভাবিকতায় আমরা ফিরছি। আগের চেয়ে কমেছে জিনিসপত্রের দামও।

“দুর্ঘটনার পর একদল ব্যবসায়ী পরিস্থিতি অস্থির করার চেষ্টা করেছিল। মোবাইল কোর্ট আর মাইকিং করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। পণ্য সরবরাহ যাতে বিঘ্নিত না হয়, সে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”

আশ্রয় কেন্দ্রে খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা যথাযথ করার উপরও জোর দিয়েছেন উষাতন তালুকদার।

গত সপ্তাহে পাহাড় ধসের পর অনেকে জেলা প্রশাসনের খোলা আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে উঠেছিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অনেকে ফিরেও যান।

সোমবার সকাল থেকে রাঙামাটি শহরে বৃষ্টিপাত শুরু হলে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার আবারও ধসের আশঙ্কায় আশ্রয় কেন্দ্রে ভিড় বাড়তে থাকে।

বিকাল পর্যন্ত রাঙামাটি জেলা প্রশাসন পরিচালিত ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৬৪৩টি পরিবারের ২৮৪১ জন আশ্রয় নেয় বলে জানান জেলা প্রশাসক। 

পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় রাঙামাটিতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার এই সংগ্রাম রাজনীতির কোনো কূটচালে যেন ব্যাহত না হয়, তাই প্রত্যাশা করছেন জনসংহতির নেতা উষাতন।  

“দলমত নির্বিশেষে রাঙামাটি পুনর্গঠনে কাজ করতে সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি। একে কেন্দ্র করে যাতে কোনো ধরনের রাজনীতি না হয়,” বলেন তিনি।