ভাঙা মন নিয়ে ভাঙা ঘর মেরামতে তারা

স্বজন হারানোর বেদনা নিয়েই পাহাড় ধসে চাপা পড়া ঘরগুলো পুনরায় দাঁড় করাতে সেগুলো পরিষ্কার ও মেরামতের কাজ শুরু করেছেন রাঙামাটি সদরে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দারা।

মিন্টু চৌধুরী, রাঙামাটি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 June 2017, 01:20 PM
Updated : 17 June 2017, 08:38 PM

নিজ উদ্যোগে স্থানীয়রা ঘর মেরামত শুরু করলেও শনিবার পর্যন্ত এ কাজে কোনো সরকারি সহায়তা মেলেনি। এর মধ্যে নতুন উপদ্রব হিসেবে যোগ হয়েছে চুরি।

পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও চুরি ঠেকাতে কেউ কেউ রাতে নিজেদের ঘরে থাকতে শুরু করেছেন।

তবে অধিকাংশ ব্যক্তিই দিনের বেলা পরিচ্ছন্নতা ও মেরামত কাজ করলেও রাতে তারা ফিরে যাচ্ছেন আশ্রয় কেন্দ্র ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে।

শনিবার রাঙামাটি সদরের ভেদভেদী দক্ষিণ-পশ্চিম মুসলিম পাড়া, নতুন পাড়া, সনাতন পাড়া, পোস্ট অফিস কলোনি ও শিমুলতলি এলাকা ঘুরে বাড়িঘর মেরামত চলতে দেখা যায়।

পাহাড় ধসের পাঁচদিন পর রাঙ্গামাটি সদরের ভেদভেদী লোকনাথ মন্দির সংলগ্ন মুসলিম পাড়ার চিত্র

পাহাড় ধসে মাটি, দেয়াল ও গাছ চাপায় এই এলাকার বেশিরভাগ ঘরই বিধ্বস্ত। মাটির নিচে চাপা পড়া ঘরগুলো থেকে কোথাও উঁকি দিচ্ছে আসবাবপত্র, তার মধ্যে আছে নিহতদের স্মৃতিচিহ্নও।

এই এলাকাগুলোর বেশিরভাগ ঘরের ভেতর জমে আছে পাহাড়ি কাদা মাটি আর ভেঙে পড়া জঞ্জাল।

এখনও বিদ্যুৎ না ফেরায় দিনেই চলছে নিজস্ব উদ্যোগের উদ্ধার ও মেরামত কাজ।

ভেদেভেদী সনাতন পাড়ার বাসিন্দা গোপাল মল্লিক (৬৫) তিন ছেলে, দুই ছেলে বউ, নাতি-নাতনিসহ ১০ জনকে নিয়ে থাকতেন তিন কক্ষের ঘরে।

গাছ ও মাটি চাপায় সেই ঘরের একটি কক্ষ মাটিতে মিশে যায়। ওই কক্ষে থাকা গোপালের ছেলে লিটন, ছেলে বউ চুমকি আর নাতি আয়ুশ (৩) মারা যান।

গোপাল মল্লিক তার স্ত্রী ও অন্য দুই ছেলেকে নিয়ে শনিবার সকালে আসেন বাড়ি পরিষ্কার করতে। ছেলে, ছেলে বউ আর নাতির একটি ছবি বুকে জড়িয়ে গোপাল ও তার স্ত্রী হাউমাউ করে কাঁদছিলেন।

ধসে ক্ষতিগ্রস্ত ঘর আবার দাঁড় করানোর চেষ্টা

গোপালের বড় ছেলে রূপন মল্লিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এক ঘরে ওরা তিন জন ছিল। গাছ আর মাটি চাপায় একসাথে মারা গেছে। বাবাও আহত হয়েছিলেন।

“চার দিন কাছেই এক জ্যাঠাত বোনের বাসায় ছিলাম। কোথায় থাকব? এখন ঘর পরিষ্কারের চেষ্টা করছি।” 

এই পরিবারের তিন সদস্য নিহত হওয়ায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ ৬০ হাজার টাকা ও ৯০ কেজি চাল মিলেছে। কিন্তু ঘর মেরামতে কোনো সহায়তা পাননি তারা।

রূপন মল্লিক বলেন, নিজেরা ঠিকঠাক করে নিতে হয়ত আরও তিন-চারদিন লাগবে।

মঙ্গলবার সকাল ৭টার দিকে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভেদভেদী পোস্ট অফিস কলোনির ‘সমবায় সমিতির পাহাড়’ ধসে পড়ে। সেখানে ছিল চার পরিবারের বসতি।

এখানে একই পরিবারের দুই ভাই সুমন ও রূপনসহ মোট চারজন মারা যান মাটিচাপায়। আহত আরেকজন ফজল করিম হারিয়েছেন কিশোর ছেলে আবদুর রহিম মুন্নাকে (১৬)।

মাটি দেয়াল ও টিন চাপায় ফজল নিজেও আহত হন। একদিন হাসপাতালে ছিলেন। শনিবার ফিরেছেন ঘর মেরামত করতে।

মাটিচাপায় তিন স্বজন হারানোর ব্যথা নিয়ে ফের সংসার গোছাতে মন দিয়েছেন তারা

ফজল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চোখের সামনে ছেলেটা মারা গেল। ঘরের সামনে দিয়ে প্রচণ্ড পানির স্রোত নামছিল। ‘একটু দেখে আসি’- বলে ছেলেটা বের হল। হঠাৎ পাহাড় ধসে মাটি ও দেয়াল চাপায় সে মারা গেছে।”

ভেদভেদী পোস্ট অফিস কলোনি নতুন পাড়ায় কবির সওদাগরের পাহাড় ধসে অটোচালক নবী ড্রাইভারের ঘরে থাকা একজন লজিং শিক্ষকসহ ছয়জন মারা যান।

নবীর ভাই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অটোচালক আবদুল খালেক বলেন, “সেহরি খাওয়ার পর ফজরের নামাজ শেষে নবী ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই এ ঘটনা ঘটে।

“আমার নিজের ঘরটা এখনও ঝুঁকিপূর্ণ। রাতে আশ্রয় কেন্দ্রে থাকি। দিনে ঘর পরিষ্কার করার চেষ্টা করি।”

পোস্ট অফিস কলোনি নতুন পাড়ার বাসিন্দা আবু বকর সিদ্দিক (৬৬) জেলা জজ কোর্ট এলাকার একটি দোকানের মালিক।

তিনি বলেন, “ঘরের ভেতর জিনিস পত্র আছে। ধসের পর একদিন আশ্রয় কেন্দ্রে ছিলাম। এরপর থেকে ঘরেই থাকছি।”

একই এলাকার সানোয়ারা বেগম বলেন, “এখন রাতে নিয়মিত চুরি হচ্ছে। তাই গতকাল থেকে বাসায় থাকছি।”

রাঙ্গামাটির পোস্ট অফিস পাড়া এলাকায় পাহাড় ধসে চাপা পড়া আসবাব পরিষ্কার করছেন বাসিন্দারা

মাটি চাপায় যারা স্বজন ও ঘর হারিয়েছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ আর আগের ঠিকানায় না ফেরার চিন্তাও করছেন। কিন্তু তারা কোথায় যাবেন সেই গন্তব্যও ঠিক করতে পারেননি।

জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য মতে, রাঙামাটি সদরের ১০টি স্থানে পাহাড় ধসে মোট ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এরমধ্যে পৌর সদরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নতুন পাড়ায় ছয়জন, সনাতন পাড়ায় তিনজন, ভেদভেদীতে পাঁচজন, শিমুলতলিতে দুইজন, পোস্ট অফিস কলোনিতে তিনজন, যুব উন্নয়ন এলাকায় আটজন, কিনামনি পাড়ায় দুজন, পশ্চিম মুসলিম পাড়ায় দুজন, লোকনাথ মন্দির সংলগ্ন মুসলিম পাড়ায় চারজন এবং মাবুদ পাড়া এলাকায় একজন মারা যান।

চাই নগদ অর্থ

রাঙামাটি সদরের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিরা বলছেন, তারা ঘরে ফিরতে চাইলেও সরকারি সহায়তা না পেলে তা সম্ভবপর হবে না।

মাটি চাপা পড়া ঘরবাড়ি থেকে অনেকে বেরিয়ে এসেছিলেন এক কাপড়ে। ঘরে ফিরলেও সেই ঘর বসবাসের উপযোগী নেই। নেই কোনো আসবাবপত্র, এমনকি খাবারের থালাও।

সদরের টেলিভিশন কেন্দ্র শেল্টার হোমে থাকা পশ্চিম শিমুলতলির বাসিন্দা অমল বালা চাকমা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুরো ঘর মাটির নিচে। খাবার প্লেট পর্যন্ত নেই। আশ্রয় কেন্দ্রে দুই বেলা খাবার পাচ্ছি।

“ফিরে গিয়ে কী করব বুঝতে পারছি না। হাতে কোনো টাকা-পয়সা নেই যে ঘর মেরামত করব।”  

রাঙ্গামাটি সদরের পাবলিক হেলথ এলাকায় এই আসবাবের দোকানের পিছনের অংশ ধসে পড়ে শনিবার সকালে

একই এলাকার কমলা রঞ্জন চাকমা বলেন, সরকারিভাবে শুধু খাবার দেওয়া হচ্ছে। ফিরে যেতে চাইলেও গিয়ে কোথায় থাকব? ঘর নেই।

এই আশ্রয় কেন্দ্রে পাহাড়ি বাঙালি মিলিয়ে আড়াইশ জন আছেন গত চার দিন ধরে।

এই কেন্দ্রে থাকা ঝিলন চাকমা, সুমেতা চাকমা, জরিনা বেগম, রমিজা আক্তার সবারই ফেরার ইচ্ছে থাকলেও ‘উপায় নেই’। 

আশ্রয় কেন্দ্রটির আরেক বাসিন্দা মোহাম্মদ মিল্টন পাহাড়ের মাটি চাপায় পা ভেঙেছেন।

চিকিৎসা শেষে আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই হলেও কখন বাড়ি ফিরতে পারবেন বা ফিরে কী করবেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন।

রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মানজারুল মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাওয়ার পর পুর্নবাসনের জন্য টিন ও নগদ অর্থ দিয়ে সহায়তা করা হবে।

“ইতোমধ্যে সরকার ৫০০ বান্ডিল টিন ও নগদ ১৫ লাখ টাকা গৃহনির্মাণ ঋণ বরাদ্দ দিয়েছে। বরাদ্দের সে টিন পেলে ধারাবাহিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারকে তিন বান্ডিল করে টিন ও নগদ নয় হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।”