পিচঢালা রাস্তা এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ নেমে গেছে ১৫০ ফুট গভীর খাদে। সেখানে সড়কের কোনো অস্তিত্ব নেই। আছে পাহাড় থেকে নেমে আসা মাটি আর কাদা।
দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে একটি সড়ক ছিল।
চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের সাপছড়ি শালবাগান এলাকায় পাহাড় ধসে এই গভীর খাদের সৃষ্টি হয়েছে।
ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে খাদের পাশের পাহাড়ের ওপর দিয়েই হেঁটে চলাচল করতে হচ্ছে এই পথের যাত্রীদের। জিনিসপত্র হাতে নিয়ে কাপড় গুটিয়ে পাহাড়ি মাটি-কাদা পেরিয়ে যেতে হচ্ছে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
ঘাগড়া থেকে রাঙামাটি পর্যন্ত সড়কজুড়ে ৩৫টি ছোট-বড় ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে পাহাড় ধস ও পাহাড়ি ঢলের কারণে।
এছাড়া ঘাগড়া বাজার এলাকায় পাহাড় ধসে সড়কের ওপর মাটি নেমে আসায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সড়ক। তিনদিন পর শুক্রবার সকালে সেই মাটি সরিয়েছে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল।
এ যেন মাটি কেটে কেটে এগোনো।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের হিসাবে সড়কপথে চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটির দূরত্ব ৭৪ কিলোমিটার। শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম থেকে রওনা হওয়ার পর প্রায় ৫০ কিলোমিটার এসে ঘাগড়া বাজার এলাকায় বাস থেকে নেমে শুরু হয় হাঁটা।
সাপছড়ি শালবাগান এলাকায় যেখানে পাহাড় ধসে খাদের সৃষ্টি হয়েছে, ওই এলাকা পার হওয়ার সময় দেখা হয় রাঙামাটির মইনুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র মনির হোসেনের সঙ্গে।
তার পরিবারের সদস্যরা থাকেন চট্টগ্রাম শহরের আতুরার ডিপো এলাকায়। বৃহস্পতিবার রাঙামাটি থেকে বাসায় ফেরার কথা থাকলেও বৃষ্টির কারণে শুক্রবার সকালে রওনা হন চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে।
মনির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিস্থিতি এরকম সেটা না দেখলে বিশ্বাস হত না। রাস্তা যে ছিল সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না।”
খাগড়াছড়ি জেলার মনীষা চাকমার মেয়ে মঙ্গলবারের ধসের আগে রাঙামাটিতে গিয়েছিলেন এক আত্মীয়র বাড়ি বেড়াতে। ধসের পর মেয়েকে আনতে শুক্রবার খাগড়াছড়ি থেকে রওনা হন মনীষা।
কিন্তু রাঙামাটির সঙ্গে খাগড়াছড়ির যোগাযোগ বন্ধ থাকায় ভোরে উঠে প্রথমে চট্টগ্রামে আসেন মনীষা। সেখান থেকে চড়েন রাঙামাটির গাড়িতে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, বাস থেকে নামার পর ঘাগড়া বাজার থেকে ২০ টাকা ট্যক্সি ভাড়া দিয়ে কলাবাগান পর্যন্ত আসতে পেরেছেন। তারপর শুরু হয়েছে হাঁটা।
রাঙামাটি সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সাপছড়ি শালবাগান অংশে বিকল্প ব্যবস্থায় লোকজন যাতে নিরাপদে অন্তত হেঁটে যেতে পারেন সেই চেষ্টা করছেন তারা। পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক যোগাযোগ চালু করার চেষ্টা চলছে।
শালবাগান এলাকার দোকানি নমনি চাকমা জানান, মঙ্গলবার ধসের পর থেকে তুমুল বৃষ্টির কারণে এই পথে লোক চলাচল ছিল খুবই কম। বৃষ্টি কমায় শুক্রবার চলাচল বেড়েছে।
এছাড়া ধসের কারণে বিচ্ছিন্ন সাপছড়ি, কলাবাগান ও মানিকছড়ি এলাকার বাসিন্দারাও বেরিয়েছেন জ্বালানি, খাবার আর প্রয়োজনীয় সামগ্রীর খোঁজে।
তাদের অনেকের হাতেই তেল সংগ্রহের জন্য ট্যাঙ্ক বা জার। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় গত চার দিনে তেল বা গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে কোনো গাড়ি রাঙামাটি যেতে পারেনি।
রাঙামাটি সদর উপজেলার বাসিন্দা বিতসি চাকমা বলেন, মানিকছড়ি থেকে ভেদভেদী পর্যন্ত অংশে জনপ্রতি ২০ টাকা এবং ভেদভেদী থেকে জেলা সদরের রিজার্ভ বাজার পর্যন্ত যেতে আরও ২০ টাকা ভাড়ায় অটোরিকশায় যাওয়া যাচ্ছে।
আগে এই পথের মোট ভাড়া ছিল ২৫ টাকা। এখন গুণতে হচ্ছে ৪০ টাকা। আর জ্বালানি তেলের সংকট থাকায় অটোরিকশার সংখ্যাও খুবই কম। ফলে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের।
রাঙামাটির সঙ্গে চট্টগ্রামের চলাচলের একমাত্র সচল ব্যবস্থা এখন নৌপথ। সদরের রিজার্ভ বাজার এলাকা থেকে নৌকায় কাপ্তাই পৌঁছে সেখান থেকে সড়ক পথে চট্টগ্রামে যাওয়া সম্ভব। রাঙামাটি-কাপ্তাই নৌ পথে বৃহস্পতিবার থেকে লঞ্চ চলাচলও শুরু হয়েছে।
শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত সেখানে মোট ১১০ জনের মরদেহ উদ্ধারের কথা জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। আর সব মিলিয়ে পাহাড়ধসের এই বিপর্যয়ে পাঁচ জেলায় ঝরে গেছে ১৫৫ জনের প্রাণ।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ জানান, শুক্রবার রাঙামাটির ভেদভেদি লোকনাথ মন্দির এলাকায় মজিবুর নামের ১১ বছর বয়সী এক শিশু এবং ভেদভেদি সেনা ক্যাম্পের পাশে ইব্রাহিম নামে ২৫ বছর বয়সী এক তরুণের লাশ পেয়েছেন তারা।
গত মঙ্গলবার থেকে ফায়ার সার্ভিসের ১২০ জন কর্মী রাঙামাটির বিভিন্ন দুর্গত এলাকায় উদ্ধার অভিযান চালিয়ে আসছেন। শুক্রবার তাদের অভিযানের এলাকা ছোট করে এখন লোকনাথ মন্দির, ভেদভেদি মুসলিম পাড়া ও সদরের রূপনগরে উদ্ধারকাজ চালানো হচ্ছে বলে শাকিল নেওয়াজ জানান।