সাজা কমিয়ে ঐশীর যাবজ্জীবন

ঢাকায় পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান হত্যা মামলায় তাদের মেয়ে ঐশী রহমানের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছে হাই কোর্ট।

মেহেদী হাসান পিয়াসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 June 2017, 05:09 AM
Updated : 5 June 2017, 01:27 PM

আলোচিত এ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামির আপিল শুনানি করে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের হাই কোর্ট বেঞ্চ সোমবার এই রায় দেয়।

হাই কোর্ট বলেছে, ঐশীর অপরাধ মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য হলেও তার বয়স ও মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সাজা কমানোর এই রায় দেওয়া হয়েছে।

এসবি কর্মকর্তা মাহফুজ ও তার স্ত্রী স্বপ্না ২০১৩ সালের ১৬ অগাস্ট তাদের চামেলীবাগের বাসায় খুন হন। ওই হত্যাকাণ্ড এবং তাতে রহমান দম্পতির কিশোরী মেয়ের জড়িত থাকার অভিযোগ নাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশকে।

ওই ঘটনায় বর্তমান সময়ের শিশু-কিশোরদের বেড়ে ওঠা এবং তাতে অভিভাবকদের ভূমিকা নিয়ে যেমন প্রশ্ন ওঠে, তেমনি ঐশীকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ‘দায়িত্বহীন’ আচরণেরও সমালোচনা হয়।   

নিহত স্বপ্না বেগম ও তার স্বামী মাহফুজুর রহমান

ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩-এর বিচারক সাঈদ আহমেদ ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর এ মামলার রায়ে ঐশীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আর বাবা-মাকে খুনের পর যে বন্ধুর বাসায় ঐশী আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই মিজানুর রহমান রনিকে দেওয়া হয় দুই বছরের কারাদণ্ড।

রনিকে বিচারিক আদালতের দেওয়া দুই বছরের ওই সাজার রায় হাই কোর্টেও বহাল রাখা হয়েছে। আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সঙ্গে ঐশীকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। 

হাই কোর্টে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহুরুল হক জহির; তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আতিকুল হক সেলিম। অন্যদিকে ঐশীর পক্ষে ছিলেন সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী।

রায়ের পর সুজিত সাংবাদিকদের বলেন, “আপিলের রায়ে আমাদের প্রত্যাশা আরও বেশি ছিল। কারণ ঘটনার সময় ঐশী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল এবং তার আচরণগত সমস্যা ছিল। যাই হোক, উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছে, তা আমরা মেনে নিচ্ছি। তবে আরও ভাল কিছু প্রত্যাশা ছিল আমাদের।”

এই আইনজীবী বলেন, ঐশীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তিনি আভাস পেয়েছেন, তারা সর্বোচ্চ আদালতে আপিলে যেতে চান।  

অন্যদিকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির সাংবাদিকদের বলেন, বিচারিক আদালত ৩০২ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ঐশীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। আর তার এক সহযোগীকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

“রাষ্ট্রপক্ষ উচ্চ আদালতে ৩০২ ধারায় ঐশীর অপরাধ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে এবং আদালত ৩০২ ধারার কনভিকশনটা বহাল রেখেছে। তবে বাস্তবতা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন দিয়েছে।”

রাষ্ট্রপক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে কি না- সে সিদ্ধান্ত পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর নেওয়া হবে বলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জানান।

পর্যবেক্ষণ

রায়ে হাই কোর্ট বলেছে, মাদকাসক্তি থেকে ‘মানসিক বিচ্যুতির’ কারণে ঐশী তার বাবা-মাকে খুন করেছে। ওই ঘটনা ঘটানোর পেছনে তার স্পষ্ট কোনো উদ্দেশ্য ছিল বলে আদালতের মনে হয়নি।

ঘটনার সময় ঐশীর বয়স ছিল ১৯ বছর। বাবা-মাকে হত্যার পর সে পালিয়ে না গিয়ে নিজেই পরে থানায় ধরা দিয়েছে। এর আগে তার আর কোনো ফৌজদারি অপরাধেরও নজির নেই।

ঐশীর দাদি ও মামার মানসিক রোগে ভোগার ইতিহাস রয়েছে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে ঐশীর মধ্যেও একই ধরনের সমস্যা পেয়েছেন।  

এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এ মামলায় ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে ঐশীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে করেছে হাই কোর্ট।

রায়ে বলা হয়েছে, “মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নয়। এটা কার্যকর করলেই যে সমাজ থেকে অপরাধ দূর হয়ে যবে তা বলা যায় না। লঘু দণ্ডও অনেক সময় সমাজ থেকে অপরাধ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বা সাহায্য করে।”

আদালত বলেছে, সন্তানদের জন্য বাবা-মা ও অভিবাবকরাই প্রাথমিক শিক্ষক। এ কারণে অভিভাবকদের উচিৎ সন্তানদের জন্য ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং সন্তানদের উপযুক্ত সময় দেওয়া।

চামেলীবাগের বাসা থেকে মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রীর লাশ উদ্ধারের পর গোয়েন্দা পুলিশের তল্লাশি

ঘটনাক্রম

স্ত্রী, দুই সন্তান এবং শিশু গৃহকর্মীকে নিয়ে মালিবাগের চামেলীবাগের এক ফ্ল্যাটে থাকতেন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান। ২০১৩ সালের ১৬ অগাস্ট ওই বাসা থেকেই তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়।

পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, আগের রাতে কোনো এক সময়ে কফির সঙ্গে ঘুমের বড়ি খাইয়ে বাবা-মাকে কুপিয়ে হত্যা করেন ঐশী। পরদিন সকালে সাত বছর বয়সি ছোট ভাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে তিনি বেরিয়ে যান। পরে ভাইকে এক প্রতিবেশীর বাসায় পাঠিয়ে একদিন পর গৃহকর্মী সুমিকে নিয়ে রমনা থানায় আত্মসমর্পণ করেন এই কিশোরী।

পরে তার বক্তব্যের সূত্র ধরে গ্রেপ্তার করা হয় তার বন্ধু মিজানুর রহমান রনি ও আসাদুজ্জামান জনিকে। পুলিশ সবাইকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে।   

রিমান্ডের পর ঐশী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও পরে তা অস্বীকার করে বলেন, ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছিল। আদালতে তিনি দাবি করেন, বাবা-মা যখন খুন হন তখন তিনি বাসায় ছিলেন না; কারা ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাও তিনি জানেন না।

অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী ঐশীর বয়স বিদ্যালয়ের নথি অনুযায়ী ১৮ বছরের কম হওয়ায় তাকে রিমান্ডে নেওয়ার মাধ্যমে শিশু আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে সে সময়। বয়সের সমর্থনে খুলনার একটি ক্লিনিকের জন্মসনদও আদালতে দাখিল করেন ঐশীর আইনজীবী।

পরে আদালতের নির্দেশে ২০১৩ সালের ২০ অগাস্ট ঐশীকে পরীক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, তার বয়স তখন ১৯ বছরের মত।

গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. আবুল খায়ের মাতুব্বর ২০১৪ সালের ৯ মার্চ আদালতে তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। তাতে বলা হয়, বাবা-মাকে ঐশীই হত্যা করেন; আর অন্যরা তাকে সহযোগিতা করেন।

পারিবারিক অ্যালবামে রহমান পরিবার

মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার পর ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর ঐশীদের বিচার শুরু হয়। বাদীপক্ষে ঐশীর চাচাসহ ৩৯ জনের সাক্ষ্য শোনে আদালত। ঐশীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হলে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে লিখিত বক্তব্য দাখিল করেন তিনি। অপর দুই আসামি জনি ও রনিও নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার চান।

এ মামলাটি দায়ের করেছিলেন নিহত মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই মো. মশিউর রহমান রুবেল। শুনানিতে তিনি আদালতকে বলেছিলেন, ভাতিজি ঐশী বাবা-মাকে খুন করতে পারে বলে তার বিশ্বাস হয় না।  

ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর যে রায় দেন, তাতে ঐশীকে মৃত্যুদণ্ড ও রনিকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলেও তাদের আরেক বন্ধু জনি খালাস পান।

ওই বছর ডিসেম্বরে খালাস চেয়ে হাই কোর্টে আপিল করেন ঐশী। সেই সঙ্গে নিম্ন আদালতের রায় ও অন্যান্য নথি হাই কোর্টে আসে মৃত্যুদণ্ডের অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য।

এরপর চলতিবছর ১২ মার্চ আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের ওপর শুনানি শুরু হয়। একটি মানবাধিকার সংস্থা ঐশীর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে রিট আবেদন করার পর হাই কোর্টের দুই বিচারক গত ১০ এপ্রিল ওই তরুণীর বক্তব্য শোনেন।

এ মামলায় ঐশীদের বাসার শিশু গৃহকর্মী খাদিজা আক্তার সুমি অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তার বিচার চলছে শিশু আদালতে। তদন্ত চলাকালে হাকিম আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ড ও পরে লাশ সরানোর ক্ষেত্রে ঐশীর কর্মকাণ্ডের বিবরণ দেয় এই বালিকা।