রিভিউ খারিজ, মওদুদকে বাড়ি ছাড়তেই হচ্ছে

মওদুদ আহমদ তিন দশক ধরে গুলশানের যে বাড়িতে বসবাস করে আসছেন, সেই বাড়ি ছাড়তে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হয়ে গেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 June 2017, 05:33 AM
Updated : 4 June 2017, 10:33 AM

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারকের বেঞ্চ রোববার এই রায় দেয়।

গুলশান-২ নম্বর সেকশনের ১৫৯ নম্বর প্লটের ওই বাড়ি মওদুদের ভাই মনজুর আহমদের নামে মিউটেশন (নামজারি) করে ডিক্রি জারির রায় দিয়েছিল হাই কোর্ট। কিন্তু আপিল বিভাগে গতবছর ২ অগাস্ট ওই রায় বাতিল হয়ে যায়।

সেই সঙ্গে মওদুদের বিরুদ্ধে সরকারি বাড়ি আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলাও বাতিল করে আপিল বিভাগ।

মওদুদের পাশাপাশি তার ভাই মনজুর আহমদ নামজারি বাতিলের বিরুদ্ধে এবং দুদক মামলা বাতিলের বিরুদ্ধে আলাদা দুটি রিভিউ আবেদন করেছিল। ওই দুই আবেদনও আপিল বিভাগ খারিজ করে দিয়েছে।

রিভিউয়ের এই রায়ের ফলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতা মওদুদ আহমদকে গুলশানের ওই বাড়ি হারাতেই হচ্ছে। তবে সরকারি বাড়ি আত্মসাতের মামলা থেকে তিনি রেহাই পাচ্ছেন।

আদালতে মওদুদ নিজেই রিভিউ শুনানিতে অংশ নেন। তার সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ ও কামরুল হক সিদ্দিকী

অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আবদুল মতিন খসরু ও খুরশীদ আলম খান।

মওদুদ আহমদ। ফাইল ছবি

‘বাড়ি ছাড়ব না’

রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মওদুদ সাংবাদিকদের বলেন, “আমি বিরোধী দলে আছি বলে আজকে এ মামলায় সাত বছর পরে আপিল করেছে সরকার।”

বাড়ি ছাড়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এখানেতো (রায়ে) সরকারকে স্বত্ত্ব দেওয়া হয়নি, অধিকার দেওয়া হয়নি। আমরা মূল মালিকের সঙ্গে বোঝাপড়া করব। উনার ছেলে করিম সুলায়মান আছেন। তাছাড়া আদালতও কিছু পর্যবেক্ষণ দেবেন।”

সরকার বাড়ি ছাড়তে বললে কী করবেন- এমন প্রশ্নে বিএনপির এই নেতা বলেন, “দেশে কি আইন নাই? আমি আইনের আশ্রয় নিব। আদালতের আশ্রয় নিব। বাড়ি ছাড়ব না।”      

‘ছাড়তেই হবে’

মওদুদ বাড়ি ছাড়বেন না বলে যে বক্তব্য সাংবাদিকদের সামনে দিয়েছেন, তা ‘এক ধরনের ধৃষ্টতা’ বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

“এ বাড়ি তিনি ছাড়বেন না বা এ বাড়িতে যে তিনি থাকবেন, একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে এ কথা বলাতো ধৃষ্টতা। আমি মনে করি এর চেয়ে বড় ধৃষ্ঠতা আর হতে পারে না। অন্য যে কোনো দেশে হলে এ প্রশ্ন ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিবিদ হিসেবে সম্মান রক্ষার স্বার্থে বাড়ি ছেড়ে দিতেন।”

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “বাড়ি অবশ্যই ছাড়তে হবে। বাড়িটা বর্তমানে নিয়ে নেওয়া সরকারের দায়িত্ব। মওদুদ আহমদ তার ভাইয়ের নামে বাড়িটির মূল মালিকের সঙ্গে যে চুক্তি দেখিয়েছিলেন, সেটার মামলা আপিল বিভাগে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। রায়ে বলা হয়েছিল- পাওয়ার অব অ্যাটর্নি এবং চুক্তিটা জাল জালিয়াতির মাধ্যমে হয়েছে।”

মাহবুবে আলম বলেন, ওই বাড়ির মূল মালিক অস্ট্রিয়ার নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজ ১৯৮৫ সালের ৩০ মার্চ মারা যান। আর মওদুদের ভাইয়ের নামে ওই প্লটের বায়না চুক্তিতে তারিখ দেখানো হয়েছিল ১৯৮৫ সালের ১০ অগাস্ট।

“তার মানে মালিক মারা যাওয়ার পাঁচ মাস পরে। আর বাড়ি পাওয়ার জন্য উনারা মামলা করেছিলেন ১৯৯৩ সালে। আপিল বিভাগ রাইটলি বলেছেন, তাদের নামে নামজারি হবে না।”

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। ফাইল ছবি

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেন, “অবৈধভাবে একজন লোক থাকবে আর সরকার সেটা মেনে নেবে, তা হতে পারে না। এ মামলায় মওদুদ সাহেব একটি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেখিয়েছিলেন, যেখানে তার ভাই তাকে বাড়িটি দেখাশুনা করার দায়িত্ব দিয়েছেন। অথচ তার ভাইয়েরও সেখানে অধিকার নাই। তার মামলা ডিসমিস হয়ে গেছে উচ্চ আদালতে।”

মূল মালিকের সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন বলে যে বক্তব্য মওদুদ দিয়েছেন, সে বিষয়ে মাহবুবে আলম বলেন, “মালিক তো বিদেশি। স্বাধীনতার পরে আসেনি কোনো সময়েই। এখানে ছিলই না। উনার এ সমস্ত কথা দুঃখজনক। মূল মালিকের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে মামলায় হেরে গিয়ে এ কথা বলাও দুঃখজনক। অবশ্যই বাড়ি ছাড়তে হবে।”

দুদকের মামলা

এক বিঘা ১৩ কাঠা জমির ওপর ওই বাড়ি অবৈধভাবে দখল ও আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর গুলশান থানায় মওদুদ ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে এই মামলা করেন দুদকের উপ-পরিচালক হারুনুর রশীদ।

দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা ২০১৪ সালের ২৬ মে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দিলে ওই বছর ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক তা আমলে নেন।

অভিযোগে বলা হয়, গুলশানের যে বাড়িটিতে মওদুদ আহমদ ও তার পরিবার থাকছেন, তার প্রকৃত মালিক ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক মো. এহসান। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ডিআইটির কাছ থেকে এই বাড়ির মালিকানা এহসান পান। ১৯৬৫ সালে বাড়ির মালিকানার কাগজপত্র এহসানের স্ত্রী অস্ট্রিয়ার নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজের নামে নিবন্ধন করা হয়।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এহসান স্ত্রীসহ ঢাকা ত্যাগ করেন। তারা আর ফিরে না আসায় ১৯৭২ সালে এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়।

ওই বছরই মওদুদ ওই বাড়ির দখল নেন। এরপর ১৯৭৩ সালের ২ অগাস্ট তারিখে তিনি ইনজে মারিয়া প্লাজের নামে একটি ‘ভুয়া’ আমমোক্তারনামা তৈরি করান এবং নিজেকে তার ভাড়াটিয়া হিসেবে দেখিয়ে ওই বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।

কবি জসীমউদ্দীনের জামাতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মপক্ষ সমর্থন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে তাকে বাংলাদেশের প্রথম পোস্ট মাস্টার জেনারেল করা হয়।

অবশ্য পরে দেশের প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগ দেন মওদুদ। জিয়া তাকে মন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী করেছিলেন। জিয়ার মৃত্যুর পর মওদুদ সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাত ধরেন। এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে তিনি মন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর মওদুদ বিএনপিতে ফেরেন এবং ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

দুদকের মামলায় বলা হয়, জিয়ার সরকারের উপ প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মওদুদ ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে গুলশানের ওই বাড়ি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেন। এর ধারাবাহিকতায় মাত্র ১০০ টাকা মূল্য দেখিয়ে ১৯৮০ সালে প্লটটি তিনি বরাদ্দ নেন।

পরে তিনি একটি বায়নানামা ‘হাজির করেন’, যেখানে দেখানো হয়, ওই বাড়ির মালিক ইনজে মারিয়া প্লাজ জনৈক মহসিন দরবারকে আমমোক্তার বানিয়েছেন এবং সেই মহসিন দরবার ১৯৮৫ সালে বাড়িটি মওদুদের সহোদর ভাই মনজুর আহমদের নামে বায়না করে দিয়েছেন। 

মওদুদ ওই অভিযোগ আমলে নেওয়ার আদেশের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে ফৌজদারি রিভিশন আবেদন করেন। শুনানি নিয়ে গতবছর ২৩ জুন হাই কোর্ট তা খারিজ করে দেয়।

হাই কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে মওদুদ আপিলের আবেদন করলে আপিল বিভাগ তা মঞ্জুর করে। এ বিষয়ে দুদকের রিভিউ আপিল বিভাগ খারিজ করে দেওয়ায় মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেন মওদুদ ও তার ভাই।

সেই বাড়ি ও আইনি লড়াই

নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, অস্ট্রীয় নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজ ১৯৮৪ সালের ২৫ জুন বাড়ির বিষয়ে মহসিন দরবার নামের এক ব্যক্তিকে কথিত পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (আমমোক্তারনামা) দেন।

রাষ্ট্রপক্ষের নথিপত্রে দেখা যায়, ১৯৮৫ সালের ৩০ মার্চ ওই অস্ট্রীয় নাগরিক মারা যান। অথচ মামলাকারীপক্ষ (মওদুদের ভাই) তাদের নথিতে দেখায়, বাড়ি নিয়ে ওই বছরের ১০ অগাস্ট তাদের মধ্যে বায়নানামা চুক্তি হয়।

তবে চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় মামলা করেন মওদুদ আহমদের ভাই। ১৯৯৩ সালের ২৩ জানুয়ারি তৎকালীন সাব জজ আদালত মামলাটি খারিজ হয়।

ওই আদেশের বিরুদ্ধে ২০০১ সালের ২৩ অক্টোবর হাই কোর্টে প্রথম আপিল করেন মওদুদ আহমদের ভাই, যার ওপর চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০০৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর হাই কোর্ট রায় দেয়।

হাই কোর্টের ওই রায়ে আবেদনকারীপক্ষ ডিক্রি পায়, ফলে সম্পত্তির মালিক হিসেবে ঘোষণা মেলে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মনজুর আহমেদের নামে আদালতের মাধ্যমে সম্পত্তির দলিল হয়।

তবে হাই কোর্টের প্রথম রায়ের বিরুদ্ধে রাজউক ২০০৮ সালে লিভ টু আপিল করে, যা তামাদি হওয়ায় আপিল বিভাগে খারিজ হয়।

রাজউক ২০১৪ সালে ওই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করে, যা শুনানির জন্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে আপিল হিসেবে গণ্য হয়। আপিল বিভাগ গতবছর ওই আপিল মঞ্জুর করে রায় দেয়।

এর আগে ওই সম্পত্তি মনজুর আহমদের নামে মিউটেশন (নাম জারি) করার নির্দেশনা চেয়ে হাই কোর্টে আবেদন করা হয় ২০১০ সালে। একই বছরের ৮ ডিসেম্বর হাই কোর্ট মওদুদ আহমদের ভাইয়ের নামে ওই সম্পত্তি নাম জারির নির্দেশ দেয়।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাজউক ও সরকারপক্ষ আলাদাভাবে লিভ টু আপিল করে, যা ২০১৪ সালে শুনানির জন্য গ্রহণ করা হয়।

এর ধারাবাহিকতায় সরকার ও রাজউক দুটি নিয়মিত আপিল করে। হাই কোর্টের প্রথম রায়ের বিরুদ্ধে রাজউকের আপিলের সঙ্গে এর শুনানি হয়।  গত ২ অগাস্ট সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দেয়, রোববার রিভিউ খারিজের মধ্যে দিয়ে সেটাই বহাল থাকল।