রোজা শুরুর কয়েকদিন আগে বৃহস্পতিবার মধ্য রাতে সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণের লেডি জাস্টিসের আদলে গড়া ভাস্কর্যটি অপসারণের কাজ শুরু হয়। তালাবদ্ধ ফটকের বাইরে বিক্ষোভের মধ্যে ভোরের আগেই শেষ হয়ে যায় অপসারণের কাজ।
কাদের উদ্যোগে ভাস্কর্যটি সরানো হল, সে বিষয়ে কারও কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি। সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তাদের মোবাইল ফোনগুলো ছিল বন্ধ, পুলিশ কর্মকর্তারাও মুখ খুলতে চাননি।
ভাস্কর্য সরানোর সময় উপস্থিত মৃণাল হকও স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি কিছু জানি না, উপরের প্রেসারে সরাতে হচ্ছে। আমাকে বলা হয়েছে সরাতে, চাপ দেওয়া হয়েছে।”
কারা চাপ দিয়েছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অনেকের অনেক রকম ক্ষমতা আছে। আমি বানিয়েছিলাম, আমাকে সরাতে বাধ্য করা হচ্ছে।
“আমার হাত-মুখ বাঁধা। মাফ চাই, আমি কিছু বলতে পারব না।”
অন্যরা সরালে ভার্স্কযটি ভেঙে কিংবা নষ্ট হতে পারে বলে আশঙ্কা থেকে নিজেই সরাতে এসেছেন বলে জানান মৃণাল হক।
তিনি বলেন, ভাস্কর্যটি সরিয়ে সম্ভবত সুপ্রিম কোর্টের এনেক্স ভবনের পাশে কোথাও বসানো হতে পারে।
রোমান যুগের ন্যায় বিচারের প্রতীক লেডি জাস্টিসের আদলে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এই ভাস্কর্যটি স্থাপনের পর গত বছর তা সরানোর দাবি তোলে হেফাজতে ইসলাম, ওলামা লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন।
গত ১১ এপ্রিল হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফী নেতৃত্বাধীন একদল ওলামার সঙ্গে গণভবনে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাস্কর্যটি সরাতে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
ভাস্কর্যটি সরানোর পক্ষে যুক্তি হিসেবে এর নন্দনতাত্ত্বিক সমস্যার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ঈদ গাহের অবস্থানের কথা বলেছিলেন শেখ হাসিনা। গ্রিক দেবীকে শাড়ি পরানো নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
ভাস্কর মৃণাল হক বলেন, “গ্রিক দেবী ঠিক নয়, বলাও ঠিক হবে না। এটা গ্রিক ভাস্কর্য নয়, একটা বাঙালি মেয়ে, শাড়ি-ব্লাউজ পরা। গ্রিক হলে সেখানে মেজকি থাকতে। ভুল জিনিস মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়।”
ভোরের আগে ভাস্কর্টি সরানো সম্পন্ন হওয়ার পর ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ভাস্কর্যটির তেমন ক্ষতি হয়নি, টাকা ক্ষতি হয়েছে। টাকার ক্ষতির চেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষের, যারা সংস্কৃতিপ্রেমী, তাদের।”
এ আগে লালনের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলায়ও আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছিলেন বলে জানান মৃণাল হক।
“কোটি টাকা নষ্ট হয়েছিল। তখন সবাই চুপচাপ ছিল, কিছু বলেনি। কোনো পক্ষ এগিয়ে আসেনি।”
বিএনপি আমলের মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হকের শ্যালক মৃণাল হকের অনেকগুলো ভাস্কর্য রয়েছে ঢাকা শহরে; সেগুলো নন্দনতাত্ত্বিক দিক নিয়ে শিল্পীদের সমালোচনা যেমন রয়েছে, তেমনি অস্বচ্ছতার অভিযোগও আছে।
তবে মৃণাল হক দাবি করেন, দেশের জন্য কাজ করার উদ্দেশ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন ছেড়ে ফিরে এসেছেন তিনি।
“আমেরিকা থেকে এসেছি, তখন ভাস্কর্য বলে ঢাকা শহরে কিছু ছিল না। আমি ঢাকা শহরে ভাস্কর্য গড়ার চেষ্টা করেছি। মতিঝিলে বক, শেরাটনের সামনে ঘোড়াগাড়ি তৈরি করেছি। অনেকে আছেন, যারা সমালোচনা করছেন, তারা কিন্তু ভাস্কর্য তৈরি করেনি। আমি কোনো স্পন্সর পাইনি, নিজের পকেটের টাকায় করার চেষ্টা করেছি, করছি।”
নিজের কাজের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, “আমি রিক্সাওয়ালা, দিনমজুর, নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য ভাস্কর্য বানিয়ে রাস্তাঘাটে দেই, যেন এটা দেখে সাধারণ মানুষের মানসিকতা পাল্টায়।
“যারা অবস্থাপন্ন তারা তো আর্ট গ্যালারি থেকে দামি দামি ছবি কিনে ঘরে সাজায়। সাধারণ মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনে তো কেউ চেষ্টা করে না। ভাস্কর্যের দিকে ১০ মিনিট তাকিয়ে যখন একজন ভিক্ষুক দেখে, তখন আমার বুকটা আনন্দে ভরে যায়।”
“আমার কাজ বন্ধ করার জন্য কয়েকটা অথরিটি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আমি যেন কাজ করতে না পারি। নিজের চেষ্টায় যারা এত দিন করেনি, তাদের ধারণা আমি অনেক টাকা বানাচ্ছি। অথচ ঢাকা শহরে প্রতিটা কাজ আমার পকেটের টাকা দিয়ে বানানো,” বলেন মৃণাল হক।
হেফাজতিদের দাবির মুখে এই ভাস্কর্য অপসারণের পর অন্য সব শিল্পকর্মও ঝুঁকির মুখে পড়ল বলে মনে করেন এই ভাস্কর্যশিল্পী।
“এরপর হয়ত অপরাজেয় বাংলা, রাজু ভাস্কর্য ও শেরাটনের সামনের ঘোড়ার গাড়ির ভাস্কর্য সরানোর নির্দেশ আসবে।”
জ্ঞানের অভাব থেকেই এটা করা হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, “প্রতিটা মুসলমান দেশে ভাস্কর্য আছে। পার্থক্য হল তারা শিক্ষিত মুসলমান, আমাদের দেশে এডুকেশন কম-ওয়ালা মুসলমান। এটাই হলো মূল কথা।”
ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিক্রিয়ায় এই শিল্পী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “কারও সন্তান হারালে যেমন লাগে তারও তেমন লাগছে।”
ভাস্কর্যটি অপসারণের দাবি মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার মৌলবাদীদের আশকারা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন এর বিরোধিতাকারীরা। ভাস্কর্য সরানোর সময়ও সুপ্রিম কোর্টের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে।
বিক্ষোভকারীদের ধন্যবাদ জানিয়ে মৃণাল হক বলেন, “আমার বুক ভরে যাচ্ছে যে কিছু যুবক ভাস্কর্য সরানোর প্রতিবাদ-আন্দোলন করছেন। এটি আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে।”