রণে ভঙ্গ নীল বিদ্রোহীদের

নিজেদের প্যানেল বাতিল হওয়ায় আদালতে যাওয়ার হুমকি দিলেও শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর আহ্বায়ক মনোনীত প্যানেলকেই সমর্থন দিতে রাজি হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের বিদ্রোহী নেতারা।

নিজস্ব প্রতিবেদকও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 May 2017, 11:43 AM
Updated : 16 May 2017, 02:10 PM

মঙ্গলবার দুপুরে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর এই সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন বিদ্রোহী প্যানেল দেওয়ার অন্যতম উদ্যোক্তা অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন নিজেদের মধ্যে আর কোনো দ্বন্দ্বে বা কলহে লিপ্ত না হতে।

“প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রতি সম্মান রেখে আমরা আইনগত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের পথে যাব না। এই প্যানেলকে আমরা সমর্থন করি উনার দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী,” বলেন নীল দলের সাবেক আহ্বায়ক সামাদ।

এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে আহ্বায়ক অধ্যাপক নাজমা শাহীনের জমা দেওয়া প্যানেলকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আলাদা প্যানেল দিয়েছিলেন সামাদরা, যার নেতৃত্বে ছিলেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ এস এম মাকসুদ কামাল।

তবে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে সোমবার তাদের প্যানেলটি বাতিল ঘোষণা করেন নির্বাচনের কমিশনার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক কামাল উদ্দীন।

তখন অধ্যাপক সামাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “আমরা এর বিরুদ্ধে রিট করব, আইনগত পদক্ষেপ নিব। আর অপরাজেয় বাংলার পাদদেশেও অবস্থান নিতে পারি।”

তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে গণভবনে ডাক পড়ে তাদের। বৈঠকে মাকসুদ কামাল ও সামাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন (অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগ), সাদেকা হালিম, এ কে এম গোলাম রব্বানী, জিনাত হুদা, এমরান কবীর চৌধুরী, জেড এম পারভেজ সাজ্জাদ, মোহাম্মদ হুমায়ুন, আবদুর রহিমসহ ১৪ জন।

বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকও ছিলেন।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর নির্দেশে আহ্বায়ক মনোনীত প্যানেলকে মেনে নিলেও নিজেদের প্যানেল বাতিলের জন্য উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিককে দায়ী করে ক্ষোভও প্রকাশ করেন অধ্যাপক সামাদ।

এদিকে নীল দলের দুই পক্ষকে নিয়ে বৈঠকের পর ওবায়দুল কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেন, “আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উনাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন।তারা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা আমাদের জন্য একটা সু-খবর।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে শিক্ষকদের ৩৫টি পদের নির্বাচনে এবার প্রার্থী বাছাইয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের নীল দলে বিভক্তি দেখা দেয়।

গত ১১ মে নীল দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক নাজমা শাহীন একটি প্যানেল জমা দেন। তার পরপরই আরেকটি প্যানেল জমা পড়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মাকসুদ কামালের নেতৃত্বে।

আলাদা প্যানেল দেওয়ার বিষয়ে অধ্যাপক সামাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মনোনীতদের নাম আহ্বায়কের প্যানেলে নেই বলে সন্দেহ করে তারা এই পদক্ষেপ নেন।

“সবসময় নামগুলো সবার সামনে ঘোষণা করে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু এবার লুকিয়ে ফেলার কারণে আমাদের সন্দেহ হচ্ছে কালকের সভার সিদ্ধান্ত উল্টে নাম বাদ কিংবা সংযুক্ত করা হয়েছে।”

আগামী ২২ মে অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত সমর্থক শিক্ষকদের সাদা দলের একটি প্যানেলও প্রতিন্দ্বন্দ্বিতায় রয়েছে।

সাদা দলের ৩৫ পদের সব ক’টিতে প্রার্থী থাকলেও নীল দলের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান সরে দাঁড়ানোয় এই প্যানেলে এখন প্রার্থী ৩৪ জন।

রঙের বিভ্রাটে প্যানেল বাতিল

ডানের গাঢ় নীল প্রচারপত্রটি ছিল নীল দলের বিদ্রোহী প্যানেলের, যাদের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে; ডানের হালকা নীল প্রচারপত্রটি নীল দলের আহ্বায়কের জমা দেওয়া প্যানেলের, যারা ভোটে টিকে আছেন

দুই প্যানেল একই রঙের কাগজে লিফলেট বিতরণ করায় তৈরি হওয়া ‘বিভ্রান্তির’ কারণে নীল দলের বিদ্রোহী প্যানেলের সদস্যদের প্রার্থিতা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচনের কমিশনার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক কামাল উদ্দীন।

তিনি বলেন, “নীল দলের আহ্বায়ক কমিটি থেকে নীল কাগজ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছে এমন অভিযোগ দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। এইসব বিষয় বিবেচনা নিয়ে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ ও শিক্ষার পরিবেশ যাতে বিঘ্নিত না হয় সেজন্য সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে।”

নীল দলের আহ্বায়কের জমা দেওয়া প্যানেলের অভিযোগের পর গত ১৪ মে তিন প্যানেলের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনা করেছিলেন বলে জানান অধ্যাপক কামাল উদ্দীন।  

“সেই মিটিংয়ে স্বতন্ত্র প্যানেলকে (নীলের বিদ্রোহী) নীল, সাদা ও গোলাপি বাদে অন্য রঙের কাগজ ব্যবহার করতে বলা হয়েছিল।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাম সমর্থক শিক্ষকদের প্যানেল হল গোলাপি; এবারের নির্বাচনে তারা অংশ নিচ্ছে না।

কী রঙের কাগজ ব্যবহার করবে তা লিখিতভাবে না জানানো এবং নির্ধারিত ‘সময়ের বাইরে গিয়ে’ মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় তাদের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে বলে জানান কামাল উদ্দীন।

অধ্যাপক কামালের কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকের কথায়ও।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শিক্ষকরা দলীয় প্রতীক হিসেবে নীল রঙ ব্যবহার করে আসছেন। অন্য শিক্ষকরাও নীল রঙের কাগজ ব্যবহার করছেন- এমন অভিযোগে নির্বাচন কমিশন ১৪ মে তাদের অন্য বর্ণের কাগজ দুপুরে মধ্যে দিতে বলেছিল। কিন্তু তারা দেননি বলে প্যানেল বাতিল করা হয়েছে।”

বাতিলের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অধ্যাপক সামাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “আমাদের পুরো প্যানেল বাদ দিয়ে এবং নীল দলের প্রত্যাহার করা প্রার্থীকে বাদ দিয়ে নীল দলের ৩৪ জনের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রিন্ট করিয়েছেন আরেফিন স্যার। আরেফিন সাহেবের পক্ষে সবই সম্ভব।

“ওনার বাসায় বসে নীল দলের সভার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে প্রার্থী তালিকা করা হয়েছিল। এখন উনার কথা একটি প্যানেল বাতিল করা হল।”

অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, “আমরা দুই পক্ষ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের। আমরা ঐতিহ্যগতভাবে নীল রঙ ব্যবহার করে আসছি সেটা ঠিক।
 
“কিন্তু একটি দল নীল রঙ ব্যবহার করলে আরেকটি এ রঙ ব্যবহার করতে পারবেন না এবং এ রঙের জন্য পুরো প্যানেল বাতিল হয়ে যাবে, এটা তো আইনি কথা না। ৭৩-এর অধ্যাদেশের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে কী রঙ নির্দিষ্ট কিছু ছিল?”
 
ঠিক সময়ে মনোনয়নপত্র না দেওয়ার বিষয়টি নাকচ করে তিনি বলেন, “ঠিক সময়ে জমা না দিলে তারা সেটা নিয়েছে কীভাবে? যথাসময়ে জমা দেওয়ার রশিদও আমাদের কাছে।”

ভোটে প্রার্থী যারা 

নীল প্যানেলে এখন প্রার্থীরা হলেন- শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহ, অধ্যাপক আবু মো. শফিউল আলম ভূইয়া, আবু মো. দেলোয়ার হোসেন, আবুল মনসুর আহাম্মাদ, আ ক ম জামাল উদ্দীন, ইসতিয়াক মঈন সৈয়দ, এস এম আব্দুর রহমান, কাজল কৃষ্ণ ব্যানার্জী, তৌহিদা রশীদ, দেলোয়ার হোসাইন, বায়তুল্লাহ কাদেরী, মুবিনা খন্দকার, মো. আফতাব আলী শেখ, মো আফতাব উদ্দিন, মো. আব্দুল আজিজ, মো. আব্দুস ছামাদ, মো. জিয়াউর রহমান, মো. ফজলুর রহমান, মো. মজিবুর রহমান, মোহাম্মাদ আলী আক্কাস, শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম, সাবিতা রিজওয়ানা রহমান, সুপ্রিয়া সাহা, সুব্রত কুমার আদিত্য, হাসিবুর রশীদ, সহযোগী অধ্যাপক এস এম রেজাউল করিম, কাজী হানিয়াম মারিয়া, চন্দ্র নাথ পোদ্দার, জান্নাতুল ফেরদৌস, পাপিয়া হক, লাফিফা জামাল, সহকারী অধ্যাপক নুসরাত জাহান ও সায়মা খানম।

সাদা প্যানেলের প্রার্থীরা হলেন- অধ্যাপক মো. আখতার হোসেন খান, আব্দুস সালাম, এ টি এম জাফরুল আযম, এ এফ এম মোস্তাফিজুর রহমান, এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম, এ বি এম শহিদুল ইসলাম, এস এম আরিফ মাহমুদ, গোলাম রব্বানী, দিলীপ কুমার বড়ুয়া, নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ, মামুন আহমেদ, মোহাম্মদ আলমোজাদ্দেদী আলফেছনী, মোহাম্মদ এমরান কাইয়ুম, মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান, মো. আবদুল করিম, মো. আশরাফুল ইসলাম চৌধুরী, মো. নুরুল আমিন, মো নুরুল ইসলাম, মো. মাহব্বত আলী, মো. মাহফুজুল হক, মো. মোশারফ হোসাইন ভূঁইয়া, মো. মোর্শেদ হাসান খান, মো. লুৎফর রহমান, মো. শাহ এমরান, মো. হাসানুজ্জামান, মো. হুমায়ুন কবীর, লায়লা নূর ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ দাউদ খাঁন, মোহাম্মদ মামুন চৌধুরী, মো. আব্দুস সালাম আকান্দ, মো. ইসরাফিল প্রাং, মো. মহিউদ্দিন ও মো. সিরাজুল ইসলাম।

নীলের বিদ্রোহী প্যানেলের প্রার্থীরা ছিলেন- অধ্যাপক মুহাম্মাদ সামাদ, মো. আনোয়ার হোসেন, সাদেকা হালিম, এ কে এম গোলাম রব্বানী, জিনাত হুদা, তাজিন আজিজ চৌধুরী, মো হারুনুর রশীদ খান, এমরান কবীর চৌধুরী, সৈয়দ মোহাম্মাদ শামছুদ্দিন, মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, শাহ মো. মাসুম, জেড এম পারভেজ সাজ্জাদ, শারমিন রুমি আলীম, মো. আসাদুজ্জামান, আবু সারা শামসু রউফ, সুব্রত কুমার সাহা, কে এম সাইফুল ইসলাম খান, মোহাম্মদ শওকত আলী, গোবিন্দ চক্রবর্তী, আখতার হোসেন, এ কিউ এম মাহবুব, সৈয়দ হুমায়ুন আখতার, মোহাম্মাদ ফিরোজ জামান, সীতেশ চন্দ্র বাছার, সৌমিত্র শেখর দে, সহযোগী অধ্যাপক সুরাইয়া আক্তার, মোহাম্মদ বিললাল হোসেন, মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির, সাব্বীর আহমেদ, সহকারী অধ্যাপক আবদুর রহিম, নাজির হোসেন খান, মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া ও মো. মনিরুল ইসলাম।