ভ্রাম্যমাণ আদালতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অসাংবিধানিক: হাই কোর্ট

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 May 2017, 09:25 AM
Updated : 11 May 2017, 01:37 PM

বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই রায় দেয়।

তিনটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১১ ও ২০১২ সালে জারি করা রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে আদালত একসঙ্গে এই রায় দিল।

আদালতে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।

হাসান পরে সাংবাদিকদের বলেন, “ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন ২০০৯ এর অধীনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে রায় দিয়েছে আদালত। আইনটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতারও পরিপন্থী।

“একইসঙ্গে এই আইনের ১১টি ধারা-উপধারাকেও অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।”

‘মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে ওই আইন সংশোধন বা নতুন আইন প্রণয়ন করে তার ভিত্তিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে’ হাই কোর্ট রায়ে বলেছে বলে জানান এই আইনজীবী।

তিনি বলেন, “মোবাইল কোর্ট আইনে আবেদনকারীদের দেওয়া সাজাও বাতিল করা হয়েছে রায়ে। এরমধ্যে এক জনকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিলো। রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ৯০দিনের মধ্যে সরকারকে সে টাকা ফেরত দিতে বলা হয়েছে।

“তবে এ আইনের অধীনে যেসব ক্ষেত্রে সাজা হয়েছে, সেগুলো অতীত বিবেচনায় মার্জনা করা হয়েছে রায়ে। যেসব সাজা উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে সেগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবেই চলবে।”

রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করবে বলে জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।

অন্য কোনো উপায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারবে কিনা জানতে চাইলে মোতাহার হোসেন সাজু সাংবাদিকদের বলেন, “হাই কোর্ট এই আইন পুরোটা বাতিল করেনি। যতোগুলো ধারা, উপধারা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল, সেগুলো অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। যেসব ধারা আদালত বাতিল করেছে এরপরও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার মতো যথেষ্ট কিনা সেটা এখন সরকার ভেবে দেখবে। এখন বিদ্যমান আইনটি সংশোধন করবে কিনা বা নতুন করে আইন হবে কি না সে সিদ্ধান্তও সরকারের।”

গ্রাম্য সালিশ আইন ও মটর পরিবহন আইন অনুযায়ী পুলিশের জরিমানার বিধানের বিষয়টি এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ উদাহরণ হিসেবে এনেছিল, আদালত তা বিবেচনায় নেয়নি।

এবিষয়ে মোতাহার হোসেন বলেন, “গ্রাম্য আদালত ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে। মটর পরিবহন আইন অনুযায়ী পুলিশও জরিমানা করে। আদালত বলেছেন, গ্রাম্য আদালত ও পুলিশ অ্যাক্টের অধীনে তারা এটা করে। সেক্ষেত্রে আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়ে বলেছে তারা সাজা দেয় না শুধু জরিমানা করে।”

ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ৫ ধারায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

আইনের ৬(১), ৬(২), ৬(৪), ৭, ৮(১), ৯ ও ১০ ধারায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পদ্ধতি, ১১ ধারায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা ও ১৩ ধারায় আপিল সংক্রান্ত বিধান রয়েছে। আর ১৫ ধারায় তফসিল সংশোধনে সরকারের ক্ষমতার বিধান রয়েছে।

রায়ের সার-সংক্ষেপে আদালত বলেছে, “ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের এসব ধারাকে মাসদার হোসেন মামলার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একইসঙ্গে সংবিধানের মৌলিক দুটি স্তম্ভ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির পরিপন্থি। তাই এ ধারাগুলোকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হলো।”

পৃথক তিনটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাই কোর্টের দেওয়া রুল রুলের ওপর গত ৮ মার্চ শুনানি শেষে আবেদনগুলো রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ ছিল।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ আইনটির কয়েকটি বিধান কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়েছিল।

২০১১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ভবন নির্মাণ আইনের কয়েকটি ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগে অ্যাসথেটিক প্রোপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুজ্জামান খানকে ভ্রাম্যমাণ আদালত একমাসের কারাদণ্ড দিলে জামিন নিয়ে ১১ অক্টোবর একটি রিট আবেদন করেন তিনি।

ওই আবেদনে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন-২০০৯ এর ধারা ৫, ৬(১), ৬(২), ৬(৪), ৭, ৮(১), ৯, ১০, ১১, ১৩, ১৫ ধারা চ্যালেঞ্জ করা হয়।

একই বছরের ১১ ডিসেম্বর ভবন নির্মাণ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে টয়নবি সার্কুলার রোডের এক বাড়ির মালিক মো. মজিবুর রহমান আদালতের জরিমানা ও কারাদণ্ডের ভ্রাম্যমাণ আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে আইনের কয়েকটি ধারার বিধান ও জরিমানার অর্থ ফেরতের নির্দেশনা চেয়ে একটি রিট করেন।

পরের বছর ২ মে দিনাজপুরের বেকারি মালিকদের পক্ষে মো. সাইফুল্লাহসহ ১৭ জন ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের কয়েকটি বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আরেকটি রিট করেন।

পৃথক ওই তিন রিট আবেদনে রুল নিষ্পত্তির জন্য একসঙ্গে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের বেঞ্চে আসে।

২০০৭ সালে ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশ জারি করে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালের ৪ অক্টোবর জাতীয় সংসদে এটিকে আইনে পরিণত করে। এরপর থেকে এটি ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন ২০০৯ নামে পরিচিত।