ধর্ষিত ছাত্রীর বর্ণনায় সেদিনের ঘটনা

ঢাকার বনানীর হোটেলটিতে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যেতে না চাইলেও পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে গিয়েছিলেন বলে ধর্ষিত এক ছাত্রী দাবি করেছেন।

গোলাম মুজতবা ধ্রুব নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 May 2017, 12:58 PM
Updated : 9 May 2017, 02:24 PM

মাসখানেক আগের এই ঘটনাটি নিয়ে গত শনিবার মামলার পর তুমুল আলোচনার মধ্যে ধর্ষিত এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী মঙ্গলবার তাদের উপর চালানো নির্যাতনের বর্ণনা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেন।

তার ভাষ্য অনুযায়ী, গত ২৮ মার্চ তিনি ও তার বান্ধবী আরেক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছিলেন সাফাত (২৬) ও তার বন্ধু নাঈম আশরাফ (৩০)।

ধর্ষণে সহযোগিতা করায় পিকাসো রেস্তোরাঁর অন্যতম মালিক মোহাম্মদ হোসেন জনির ছেলে সাদমান সাকিফ (২৪) এবং সাফাতের দেহরক্ষী ও গাড়িচালককেও মামলার আসামি করা হয়েছে।

মামলা দায়েরের পর তিন দিন গড়ালেও পাঁচ আসামির কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

পালিয়ে থাকায় আসামিদের কোনো বক্তব্যও সংবাদকর্মীরা পাচ্ছে না।

তবে প্রধান আসামি সাফাতের বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের দাবি, ষড়যন্ত্র করে তার ছেলেকে ফাঁসানো হয়েছে।

ঘটনার দিন যৌন সংসর্গের কোনো ঘটনা ঘটলে তা উভয় পক্ষের ইচ্ছানুসারে ঘটেছে বলে দিলদারের দাবি; তবে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন ধর্ষণের অভিযোগকারী তরুণী।

ওই তরুণী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই দিন (২৮ মার্চ) বারবার ফোন করে বলেছিল আমরা দুই বান্ধবী তার জন্মদিনে না গেলে তিনি কেক কাটবেন না।”

অনুষ্ঠানে অনেকে থাকবে জানানো হলেও রেইনট্রি হোটেলে গিয়ে কয়েকজন ছাড়া কাউকেই দেখেননি বলে জানান এই তরুণী।

“গিয়ে দেখি সাফাত, নাঈম আশরাফ, সাদমান সাকিফ এবং তাদের দুই বান্ধবী রয়েছেন। আমরা তিন বান্ধবী ও এক চিকিৎসক বন্ধু সেখানে গিয়েছিলাম। হোটেলটির মালিক পরিচয় দিয়ে এক লোক সাফাতের জন্য জন্মদিনের কেক নিয়ে এসেছিল।”

তরুণীর মামলায় অভিযোগ করা হয়, পরিবেশ ভালো না লাগায় তারা তিন বান্ধবী ও তাদের চিকিৎসক বন্ধু চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে সাফাত-নাঈমরা তাদের গাড়ির চাবি কেড়ে নেয়। এরপর শুধু তাদের দুজনকে (ধর্ষিতা দুই ছাত্রী) নিচে একটি কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করে এবং পরদিন সকাল ১০টায় তাদের ছেড়ে দেয়।

সাফাত আহমেদ

এই তরুণী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা অনেক চিৎকার করেছি। ওদের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছি। সাফাত ও নাঈমের হাত-পা ধরে ক্ষমা চেয়েছিলাম। নিজেদের সম্ভ্রম ভিক্ষা চেয়েছিলাম। কিন্তু রেহাই পাইনি।”

এই তরুণী বলেন, ওই হোটেলে যাবার পরই সাফাত ও নাঈম বলে তারা তিন দিন ধরে একটানা ইয়াবা খাচ্ছে।

“ধর্ষণের সময়ও তারা দুজন পাশের বাথরুমে গিয়ে একটু পর পরই ইয়াবা খেয়ে আসছিল। এসেই আমাদের দুজনকে মারধর করছিল, কখনও গালি দিচ্ছিল।”

সাফাতের মাদকাসক্তির কথা তার সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।

ধর্ষিত তরুণী বলেন, ধর্ষণের ঘটনা ফাঁস করলে সাফাতের দেহরক্ষীর অস্ত্র দেখিয়ে তাদের মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়।

“সাফাত বলছিল, তারা সোনার ব্যবসা করে। অনেক প্রভাবশালী। খুন করে ফেললেও তার কোনো সমস্যা হবে না।”

তিনি বলেন, “ধর্ষণের সময় আমরা আমাদের মেরে ফেলতে বলেছিলাম। সারারাত আমাদের উপর চলে বর্বর অত্যাচার। দেহরক্ষীকে দিয়ে তার ভিডিও করা হয়। সকালে হোটেলে একটি গাড়ি আসতে বলে। আমার বান্ধবীটা যন্ত্রণায় হাঁটতে পারছিল না। আমরা দুজনই কাঁদছিলাম।”

গুলশানে সাফাতদের বাসা আপন ঘর

ওই গাড়িতে উঠে সাফাত ও নাঈম গুলশানের বাড়ির সামনে নেমে যাওয়ার পর দুই তরুণী তাদের চিকিৎসক বন্ধুকে টেলিফোন করে ডেকে এনে গুলশানের আরেকটি হোটেলে বসেন।

“ওই চিকিৎসক বন্ধুকেও ওইদিন হোটেলের আরেকটি রুমে আটকে রাখা হয়েছিল। তার সঙ্গে আমাদের আরেক বান্ধবীও ছিলো। আমাদের ধর্ষণের আগে ও পরে ওই বন্ধুকে ওরা প্রচণ্ড মারধর করে।”

ধর্ষণের ঘটনা চেপে রাখলেও ভিডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্রমাগত হুমকির মুখে মামলার সিদ্ধান্ত নেন বলে এই তরুণী জানান।

“ধর্ষণের ভিডিওর ছবি ফেইসবুকে ছড়িয়ে দেবার হুমকি দিয়ে আমাদের সারাজীবন নিজেদের রক্ষিতা করে রাখতে চেয়েছিল ওরা। এটা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।”

ঘটনার পর দুই ‘বড় ভাই’র মধ্যস্ততায় পিকাসো হোটেলে সাফাতদের সঙ্গে একটি বৈঠক হয়েছিল বলে জানান এই তরুণী, সেখানে সাফাত, নাঈম ও সাদমান সাকিফ ছিলেন।

“ওরা ছিল ভাবলেশহীন, যেন কিছুই হয়নি। বড় দুই ভাই ওদের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করলে তারা তাচ্ছিল্য করে বলে, ‘ভাই, ওইদিন আমরা ইয়াবা খেয়েছিলাম, নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে যা ভালো মনে হয়েছে, করেছি,” কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন এই তরুণী।

পরিচয় সাদমানের সূত্রে

সাদমান সাকিফের সূত্রে গত মার্চ মাসের শুরুতে সাফাতের সঙ্গে পরিচয় বলে ধর্ষিত তরুণী জানান।

সাদমান রেগমান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হোসেন জনির ছেলে। সাদমান নিজেও রেগনাম গ্রুপের একজন পরিচালক। এই গ্রুপের ভবনেই রয়েছে পিকাসো রেস্তোরাঁ। রেগনামের ওয়েবসাইটেও পিকাসোর নাম রয়েছে।

সাদমানের সঙ্গে দুই বছরের বন্ধুত্ব ছিল জানিয়ে ওই তরুণী বলেন, “তাকে বন্ধু হিসেবে অনেক বিশ্বাস করতাম। নিজের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা ভাগাভাগি করে নিতাম। ওর জন্যই ওইদিন সাফাতের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণে যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও গিয়েছিলাম।

সাদমান সাকিফ

“অথচ ওদের আমাদের দুই বান্ধবীকে ধর্ষণ করার পূর্ব পরিকল্পনা ছিল। সেটা সাদমান জানলেও আমাদের দুজনকে বুঝতেই দেয়নি।”

ওই তরুণী বলেন, গত ৭ মার্চ গুলশানের একটি হোটেলে এক অনুষ্ঠানে সাদমান তার বড় ভাই বলে সাফাতকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে সাফাতের স্ত্রী (পরে ডিভোর্স হয়েছে) ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাও ছিলেন।

অভিযোগকারী তরুণী বলেন, এরপর সাদমান ফোন করে তাকে ও তার বান্ধবীকে পিকাসো রেস্তোরাঁয় নিয়ে যান। সেখানে মদের কয়েকটি বোতলসহ সাফাত বসেছিলেন।

“আমি ও আমার বান্ধবী সেখানে যাওয়ার একটু পরই সাফাত অকথ্য ও অশ্লীল ভাষায় তার স্ত্রীকে গালাগাল করতে থাকে। নিজেকে অনেক দুঃখী মানুষ বলছিল সে। পরিচয়ের প্রথম দিকে একটা লোকের এমন আচরণে আমরা খুব বিরক্ত হই।”

ঘটনার পর সাদমানের সঙ্গে ওই তরুণীর ফেইসবুক কথোপকথনে আসে ধর্ষণের কথা

সেদিনই সাফাত তার ফোন নম্বর দুই তরুণীর মোবাইলে সেইভ করে দেওয়ার পাশাপাশি ফেইসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলেন।

“এভাবে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। এরপর অন্তত দুবার পিকাসো রেস্তোরাঁয় আমি তার সঙ্গে দেখা করি। সাফাত বারবার আমার সঙ্গে একা ছবি তুলতে চাইত, অনেকটা জোর করে ছবিও তুলত। আমি ওকে বলেছি আমার একটা অ্যাফেয়ার রয়েছে। তখন সে বলে, তারও একটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। বন্ধু হিসেবে তার আমাকে ভালো লাগে। স্ত্রীকে তার ভালো লাগে না।”

২০১৫ সালে ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাকে বিয়ে করেন সাফাত। এনটিভির ‘সুপার হিরো, সুপার হিরোইন’ প্রতিযোগিতার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পিয়াসা। ধর্ষণের ঘটনাটির ২০ দিন আগে গত ৮ মার্চ তাদের ছাড়াছাড়ি হয়।

সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ বিশ্বাস করছেন পিয়াসা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ও আমার লাইফ ধ্বংস করেছে বিয়ে করে। ওদের দুজনের লাইফ ধ্বংস করেছে বিয়ে না করে।”

“সাফাত আমাদের ডিভোর্সের কথা কাউকে বলতো না। আমার বিরুদ্ধে খারাপ কথা বলে অন্য মেয়েদের মনোযোগ কাড়তে চাইত।”

দিলদারের অভিযোগ, পিয়াসার ষড়যন্ত্রেই তার ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের এই অভিযোগ তোলা হয়েছে।

“বউয়ের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের কারণে ছেলে তাকে তালাক দেয়। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সেই ষড়যন্ত্র করে ওই দুই মেয়েকে দিয়ে সাজানো মামলা করিয়েছে। মামলা করতে থানায় ছেলের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীও গিয়েছিল।” 

তবে পিয়াসা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।