দুই তরুণীকে ধর্ষণ: সাফাত বাসায়, পুলিশ ধরার ‘চেষ্টায়’

ঢাকায় দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণের আলোচিত ঘটনার প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ বাসায় থাকা অবস্থায়ও তাকে না পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ।

গোলাম মুজতবা ধ্রুব নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 May 2017, 05:03 PM
Updated : 9 May 2017, 05:22 AM

সাফাতের বাবা দিলদার আহমেদের বক্তব্য অনুযায়ী, সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তার ছেলে তার গুলশানের বাসাতেই ছিলেন।

গত শনিবার মামলা দায়েরের পরদিন তদন্ত কর্মকর্তা বনানী থানার পরিদর্শক আবদুল মতিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, কয়েকবার বাড়িতে গিয়েও সাফাতকে পাননি তারা।

সোমবার দুপুরে ও সন্ধ্যায় গোয়েন্দা পুলিশের ডিবির উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম দুদফা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ধর্ষণের এই আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা।

তবে এরপর রাত ৯টার দিকে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি বাসার বাইরে আছি। সাফাত বাসায় একটু আগেও ছিল।”

পুলিশ তাকে না পাওয়ার কথা জানাচ্ছে- বলা হলে তিনি বলেন, “এখন সে বাসায় নেই। পুলিশ ওকে খুঁজছে বলে হয়ত কোথাও পালিয়ে গেছে।”

মাসখানেক আগের ঘটনার উল্লেখ করে ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলাটি ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ বলে দাবি করেন ব্যবসায়ী দিলদার।

গত শনিবার বনানী থানায় মামলাটি দায়েরের পর এখনও পাঁচ আসামির কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

আসামিদের মধ্যে সাফাত (২৬) ছাড়াও রয়েছেন একজন ঠিকাদারের ছেলে নাঈম আশরাফ (৩০), পিকাসো রেস্তোরাঁর অন্যতম মালিক মোহাম্মদ হোসেন জনির ছেলে সাদমান সাকিফ (২৪)। বাকি দুই আসামির একজন সাফাতের দেহরক্ষী ও অন্যজন গাড়িচালক।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সাফাত, নাঈম, সাদমান এবং ঢাকার একজন সংসদ সদস্যের ছেলে বনানী ১১ নম্বর সড়কে একটি রেস্তোরাঁ চালান। এছাড়া তাদের একাধিক সীসা বার রয়েছে।

মামলার বাদী শিক্ষার্থীর অভিযোগ, সাফাতের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেয়ে ২৮ মার্চ এক বান্ধবীসহ তিনি ‘দি রেইনট্রি’ হোটেলে গিয়েছিলেন। সেখানে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাতভর আটকে রেখে সাফাত ও নাঈম তাদের ধর্ষণ করেন। অন্য তিনজন তাতে সহায়তা করে।

আসামিদের চিহ্নিত করা গেছে বলে জানিয়েছেন ডিবির উপ-কমিশনার নাজমুল; যে সংস্থাটি থানা পুলিশের পাশাপাশি মামলাটির ছায়াতদন্ত করছে।

বনানী থানা

তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজখবর নিয়ে আসামিদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে জানিয়ে তিনি দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “তদন্তের স্বার্থে আসামিরা কোথায় আছে, তা বলা যাবে না। তবে তাদের শনাক্ত করা হয়েছে।” 

বিকালে বনানী থানায় ওসি বিএম ফরমান আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনাটি তদন্ত করে আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে পুলিশ।”

একই সময় ফোন করা হলে তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল মতিন বলেন, “ভাই, আমি মামলার আসামিদের তথ্য সংগ্রহে থানার বাইরে আছি।”

ডিবির উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সন্ধ্যায়ও আসামিদের গ্রেপ্তারে কাজ করেছে পুলিশ। অপরাধী যেই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।”

আসামিরা প্রভাবশালী বলে থানা পুলিশের সঙ্গে ডিবিও কাজ করছে বলে জানান তিনি; তবে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে সরকারের কোনো পর্যায় থেকে চাপ না থাকার কথাও বলেন তিনি।

অপরাধীরা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন তাদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিয়ে নাজমুল বলেন, “আসামিরা যাতে দেশ ছাড়তে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।”

এখন পর্যন্ত কোনো আসামির দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার তথ্য পুলিশের কাছে নেই বলে জানান এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

এর আগে যুদ্ধাপরাধের মামলার আসামি আবুল কালাম আযাদ (বাচ্চু রাজাকার) পুলিশের ‘নজরদারিতে’ থাকার মধ্যেই বিদেশি পালিয়ে যান। আলোচিত মামলার আসামিদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার নজির আরও রয়েছে।

সাফাতের সাবেক স্ত্রীর অভিযোগ

সাফাতের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে তার বাবা দিলদার হোসেন অপপ্রচার চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন তার সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা।

ব্যবসায়ী দিলদার দাবি করেছিলেন, তার ছেলের বিরুদ্ধে সাবেক স্ত্রী প্রতিহিংসা করে দুই মেয়েকে দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ করিয়েছেন।

সাফাত আহমেদ

তিনি বলেছিলেন, দুই বছর আগে টেলিভিশন উপস্থাপিকা পিয়াসাকে সাফাতের বিয়েটি তারা মেনে নেননি।

“পরে বউয়ের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের কারণে ছেলে তাকে তালাক দেয়। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এই উপস্থাপিকাই ষড়যন্ত্র করে ওই দুই মেয়েকে দিয়ে সাজানো মামলা করিয়েছে।”

তার অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় পিয়াসা সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাফাত বিনা কারণেই আমাকে ডিভোর্স করেছিল এ বছরের ৮ মার্চ। তার দুই সপ্তাহ পার না হতেই তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। সাফাত আমাকে বিয়ের আগেও একবার বিয়ে করেছিল।” 

“ওই মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হওয়ার সময়ও জানত না সাফাতের সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়েছে। তাই তারা আমার কাছেও অভিযোগ করেছিল,” বলেন তিনি।

মামলার সময় থানায় পিয়াসারও উপস্থিত থাকার কথা বলেছিলেন দিলদার, যা নাকচ করেন এই নারী। 

তিনি বলেন, “বনানী থানার ওসি ও সাফাতের বাবা তার ছেলের অপরাধকে ঢাকতে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ওই মেয়েদের করা মামলার এজাহারে আমার নাম জুড়ে দিয়েছে। যেন মূল ঘটনাটা আড়ালে গিয়ে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে বেশি আলোচনা হয়।”

মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি  

ঢাকায় জন্মদিনের পার্টিতে ডেকে নিয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণের আলোচিত এই ঘটনাটি গণমাধ্যমে দেখে তা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।

তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য সাবেক সচিব নজরুল ইসলাম, নুরুন নাহার ওসমানী, এনামুল হক চৌধুরী, কমিশনের পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন, উপ পরিচালক রবিউল ইসলাম।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ভিকটিম ও তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।

“তাদের অভিযোগ আমলে নিয়ে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটি আগামী ১৫ দিনে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে তা যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন জমা দেবে।”